হোর্হে লুই বোর্হেস ও তাঁর গল্পের অলীক বাস্তবতা
- 06 January, 2021
- লেখক: রণজিৎ অধিকারী
লাতিন আমেরিকান বুম এর শুরুটা হয়েছিল বিশ শতকের ষাটের দশকের চার লেখকের হাত ধরে। গার্সিয়া মার্কেজ, হুলিও কোর্তাসার, কার্লোস ফুয়েন্তেস, মারিও ভার্গাস ইয়োসা - এনারা সারা পৃথিবীর সাহিত্য পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছিলেন। এনাদের ঠিক আগে আরো চার বিশিষ্ট লাতিন আমেরিকান লেখক বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছিলেন। তাঁদের অন্যতম হোর্হে লুই বোর্হেস। বাকিরা হলেন আস্তুরিয়াস, আলেহো কার্পেন্তিয়ের এবং হুয়ান রুলফো।
'স্মৃতিধর ফুনেস' গল্পটি দিয়েই বোর্হেস আলোচনা শুরু করা যাক। প্রায় প্রতিটি গল্পেই লেখক উত্তম পুরুষে উপস্থিত থাকেন, কিন্তু সেটা তাঁর একটা বিশেষ অভিপ্রায় ছাড়া কিছু নয়, হয়তো বিষয়টাকে আরো বেশি গুলিয়ে দিতে চান। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।
'স্মৃতিধর ফুনেস' গল্পে ফুনেস নামের এক ছেলের কথা বলছেন লেখক, বললেন, ১৮৮৭ সালে তাকে শেষবার দেখেছেন আর পাঠকের মনে থাকবে নিশ্চয়ই বোর্হেসের জন্ম ১৮৯৯-এ। শুরুতেই এটা উল্লেখ করলাম এই জন্যই যে, পাঠক যদি সাবধান না হন, তাঁকে গ্রাস করে নিতে লেখকের বেশি সময় লাগবে না।
ফুনেস কিছু ভুলতে পারেনা, তাই তার আছে অর্থহীন স্মৃতির ভাণ্ডার, যার মধ্যে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পায়না অথচ সে তার দেখা প্রতিটি পাহাড়ের প্রতিটি গাছ শুধু নয়, তার পাতাগুলিকেও নিখুঁতভাবে মনে রাখতে পারত।
ফুনেস বুঝতে পারত না, আগেই নামকরণ হওয়া বস্তুটি সময়ের সঙ্গে বদলে গেলেও কীভাবে তাকে একই নামে চিহ্নিত করা যায়! ফুনেস চাইত বস্তুর প্রতিটি মুহূর্তে ভিন্ন ভিন্ন নাম, কীভাবে কিছুক্ষণ আগে দেখা কুকুর আর কয়েকমিনিট পরে দেখা কুকুরকে একই শব্দে চিহ্নিত করা যায়! ফলে শব্দভাণ্ডার হবে অনন্ত।
অথচ সে নিজেই উপলব্ধি করত, তার স্মৃতি অনেকটা আবর্জনা স্তূপের মতো। এর থেকে নিস্তার পেল তখনই, যখন সে ফুসফুসে রক্ত জমে মারা গেল।
গল্পটি বোর্হেসের প্রতিটি গল্পের মতোই একাধিক পাঠের দাবি রাখে এবং তারপরও গল্পের আবেদন কেবল চিন্তার কাছে, বুদ্ধির কাছে, কিন্তু হৃদয়ের কাছে নয়।
বাংলাদেশের আর্দ্র সিক্ত জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা বাঙালি পাঠকের তাঁর গল্প পড়ে মনে হতেই পারে —নির্দয় এমনকি রসহীন, মনে হওয়া স্বাভাবিকও বটে। খুব নিরপেক্ষভাবে পাঠককে বোর্হেসের জগৎ আবিষ্কারে এগোতে হবে। কেননা আমরা রবীন্দ্রনাথের 'ছুটি', বিভূতিভূষণের 'পুঁইমাচা'-র মতো অসামান্য মর্মন্তুদ গল্প পড়ে চোখের জল ফেলি, আমরা চাইও যে গল্প যেন হৃদয়কে নাড়া দেয়। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা গল্পের আবেদন বুদ্ধির চেয়ে হৃদয়ের কাছেই বেশি। ঠিক এই অবস্থান থেকে বোর্হেসকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে।
কেননা যতদিন গেছে বোর্হেসের গল্প ততই আখ্যানকে অস্বীকার করে একটা নিরেট পাথরের মতো তত্ত্ব বা কল্পনায় সৃষ্ট গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছে। পাঠক তাঁর মেধা দিয়ে যদি না সেই ধাঁধার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন তবে তিনি গল্পের স্বাদ গ্রহণে ব্যর্থ হতে পারেন। জিউসের পুত্র মিনোস ডায়েডালাস-কে এমন এক গোলকধাঁধা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেখান থেকে
দানব মিনোটর বেরোতে না পারে। কিন্তু থিসিয়াস মিনোটরকে বধ করে বেরিয়ে আসবেন কীভাবে!
থিসিয়াসের প্রেমিকা ও মিনোস-কন্যা আরিয়াডনির পরামর্শে ডায়েডালাস থিসিয়াসকে একটা সুতোর গুলি দেয়, তরবারির আঘাতে মিনোটরকে হত্যা করে সুতো দ্বারা চিহ্নিত পথ দিয়ে গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি।
গ্রিক পুরাণের এই গল্পটি বোর্হেসের গল্পের ক্ষেত্রে যেন প্রতীকী হয়ে ওঠে। পাঠককেও তাঁর গল্পের ভেতর থেকে সুতো ধরে বেরিয়ে আসতে হবে নইলে লেখকের বানানো গোলকধাঁধা থেকে উদ্ধারের উপায় নেই।
এর সঙ্গে যোগ হবে পাঠকের শ্রম, এই শ্রম পুরোপুরি জ্ঞাননির্ভর। তাঁর যেকোনো একটা গল্প, ধরা যাক 'আল-মুতাসিমের সান্নিধ্য' —এই ছোট্ট গল্পটি অনুধাবন করতে গেলে পাঠককে কয়েকটি বিষয় জানতেই হবে, যেমন — আব্বাসিদ (৭৫০ থেকে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করা এক ইসলামিক বংশ), আল-মুতাসিম (আব্বাসিদ বংশের অষ্টম প্রতিনিধি, সাহসী প্রাণোচ্ছল অশিক্ষিত কিন্তু বলবান), গিলবার্ট কিথ চেস্টারটন, এডওয়ার্ড ফিট্সজেরাল্ড, হোমার, ইব্বুর(কোনো মানুষের আত্মা জীবদ্দশায় অন্যের শরীরে প্রবেশ করতে পারে এমন বিশ্বাস), নিশাপুর (ইরানের শহর), আইজাক লুরিয়া ( ১৫৩৪-১৫৭২, কাববালাবাদী), প্লোটিনাস (মিশরে জন্ম, নব্য প্লেটোবাদের প্রবক্তা), ইউলিসিস, তুলে (চেঙ্গিস খাঁ-র চতুর্থ ও শেষ পুত্র), স্পেন্সার ইত্যাদি।
একটি গল্প পড়তে পাঠককে ন্যূনতম এই বিষয়গুলি জানতেই হবে, নাহলে গল্পের রহস্য অধরাই থেকে যাবে।
হোর্হে লুই বোর্হেস ১৮৯৯ সালে আর্হেন্তিনার বুয়েনস আইরিস-এ জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর শিশুকাল কাটে তাঁর পিতার গ্রন্থাগারে, যেখানে ইংরেজি ফরাসি ও স্প্যানিশ বইয়ের বিপুল সমাহার ছিল।
১৯১৪ সালে পরিবার সহ ইউরোপ চলে গেলেও ১৯২১-এ পুনরায় আর্হেন্তিনায় ফিরে আসেন। এইসময় কিছুদিন কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করেন এবং কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন, ১৯৩৮ সালে বুয়েনস আইরিস-এর এক গ্রন্থাগারের প্রধান পদে নিযুক্ত হন।
১৯৩৫ থেকেই বোর্হেস প্রধানত গল্প লিখতে শুরু করেন। ১৯৩৫-১৯৪০-এ যে গল্পগুলি প্রকাশিত হয় সেগুলি ফিকশনধর্মী, তুলনায় সহজবোধ্য তবে ১৯৪০-এর পর থেকে তাঁর গল্প একেবারেই ভিন্ন চরিত্রের হয়ে ওঠে। কখনো মেটাফিজিক্যাল ভাবনাকে রূপ দিতে চেয়েছেন গল্পে, কখনো কোনো পুরাণের গল্পকে নতুন রূপ দিয়েছেন। 'ব্রডির রিপোর্ট' গল্পসংকলনে দেখব লেখক বিশেষ কোনো পূর্বনির্ধারিত চিন্তাকে কাল্পনিক আকার দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
ধারাবাহিক ভাবে আমরা যদি বোর্হেসের গল্প পড়ে যাই, তবে আমরা কী কী পাব? দুর্বৃত্তদের লড়াই, ছোরাযুদ্ধ, মৃত্যু, কখনো কখনো তত্ত্বের প্রয়োগ ইত্যাদি।
তাঁর কিছু গল্প নির্মিত হয়, দেশবিদেশের পুরাণ ইতিহাস ধর্মতত্ত্ব ও অধিবিদ্যা সংক্রান্ত বিপুল জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে, কখনো কখনো গল্প প্রবন্ধের রূপ নেয়।
কখনো তাঁর গল্পের চরিত্র উঠে আসে কোনো কিংবদন্তি বা কোনো উপকাহিনী থেকে কিংবা কখনো ইউরোপ আফ্রিকার পুরাণ বা ইতিহাস থেকে।
কিছু গল্প পড়লে প্রথম পাঠে একটি নিরীহ কাহিনী মনে হলেও আরো কয়েকবার পাঠ করলে ধরতে পারা যায় যে, চরিত্রগুলো লেখকের কল্পনার দাসত্ব করছে মাত্র, তারা কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসেনি, বরং তারা পুরোপুরি লেখকের মস্তিষ্কে নির্মিত —যদিও তাদের আচরণ সম্পূর্ণভাবে বাস্তব। আসলে লেখকের কোনো বিশেষ আইডিয়াকে রূপ দিতে অথবা কোনো বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তাদের আনা হয়েছে গল্পে।
এই প্রসঙ্গে দুটি গল্পের কথা মনে পড়ছে —'সাক্ষাৎ' ও 'প্রতিদ্বন্দ্বিতার শেষে'।
'সাক্ষাৎ' গল্পে লেখক দুই ছোরা যোদ্ধার লড়াইয়ের কথা লেখক বলেছেন। উরিয়ারতে আর ডানকান। দুজনে পোকার খেলছিল এবং কিছুক্ষণ খেলার পরই উরিয়ারতে চিৎকার করতে থাকে যে, ডানকান তাকে ঠকাচ্ছে। উরিয়ারতের ক্রমবর্ধমান চিৎকার সহ্য করতে না পেরে লম্বা বলিষ্ঠ চেহারার ডানকান একটা ঘুষি চালাল কিন্তু মেঝে থেকে উঠে উরিয়ারতে ঘোষণা করল সে এক্ষুনি লড়াই করবে, ডানকান যদিও রাজি ছিল না।
গৃহকর্তার সংগ্রহে ছিল বিখ্যাত যোদ্ধাদের ব্যবহৃত অসংখ্য ছোরা। কাচের আলমারি থেকে উরিয়ারতে বেছে নিল সবচেয়ে ঝকমকে লম্বা ছোরাটা আর ডানকান যেন অন্যমনস্ক ভাবে কাঠের হাতলওয়ালা একটা বেঁটেখাটো ছোরা তুলে নিল।
লড়াই ভালোই চলল। "ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার কিছু না থাকায়, ছোরার খোঁচা ঠেকাবার জন্য ওরা হাতই ব্যবহার করল। আস্তিনগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ঝুলতে লাগল, তারপর রক্তে কালো হয়ে গেল।" এবং শেষে উরিয়ারতে ডানকানের বুকে ছোরা ঢুকিয়ে দিল।
কিন্তু গল্পটা আসলে এখানেই শুরু হল, কেননা লড়াইটা দুজন মানুষের মধ্যে ছিল না।
এরপর ওই ছোরা দুটির ইতিহাস বললেন লেখক এবং সবশেষে সেই বোর্হেসীয় মোচড় :
"কিন্তু সত্যিকারভাবে আমরা হয়তো অন্য একটা গল্পের, পুরোনো একটা গল্পের শেষাংশ দেখেছিলাম। আমি ভাবলাম, উরিয়ারতেই কি ডানকানকে মেরেছিল না কোনো অলৌকিক উপায়ে মানুষ নয়, অস্ত্রগুলো যুদ্ধ করল। ছোরাটা হাতে নিয়ে উরিয়ারতের হাত কীভাবে কাঁপছিল তা আমার মনে আছে, একইরকম হয়েছিল ডানকানেরও, যেন আলমারিতে পাশাপাশি রাখা ছোরাগুলো দীর্ঘ ঘুমের পর জেগে উঠতে লাগল।...
বস্তু মানুষের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, কে জানে আবার কখনো ছোরা দুটোর সাক্ষাৎ হবে কিনা, কে জানে গল্পের শেষ এখানেই কিনা।"
পাঠক একাধিক পাঠে আবিষ্কার করবেন যে গল্পটি দুজন মানুষের লড়াই নয়, দীর্ঘজীবী অস্ত্র তথা বস্তুরাই লড়াই করে চলেছে এক একটা দীর্ঘ বিরতির পর, মানুষ নিমিত্ত মাত্র।
লেখক নিছক এই তত্ত্বটি প্রমাণের জন্য যেন উরিয়ারতে আর ডানকানকে গল্পে হাজির করেছেন।
'প্রতিদ্বন্দ্বিতার শেষে' গল্পেও দুজন কাউবয়ের গল্প শুনিয়েছেন লেখক। তারা হতদরিদ্র ছিল কিন্তু তাদের একঘেয়ে জীবনে পারস্পরিক ঘৃণা ছিল প্রবল, এবং নানা ছুতোয় তাদের লড়াই লেগে যেত। এইভাবে নিজেদের অজ্ঞাতেইতারা একে অপরের দাসে পরিণত হয়েছিল। অন্তত এক শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া তাদের মধ্যেকার শেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতাটি মানুষ স্মরণ করতে পারে।
১৮৭০ সালে শীতকালে ক্ষমতাসীন কলোরাডো বা লালদের সঙ্গে অ্যাপারিসিও ব্ল্যাঙ্কো বা সাদাদের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এবং ঘটনাচক্রে অনেকটা বাধ্য হয়েই সিলভিরা আর করদোসো দুজনেই সাদাদের সৈনবাহিনীতে যোগ দেয়। সাদাদের সংখ্যা বেশি হলেও যুদ্ধে জয়লাভ করে কুশলী লালেরা। সাদারা বন্দী হলে লালেদের অধিনায়ক হুয়ান প্যাট্রিশিও নোলান ঘোষণা করল —পরের দিন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুজনের দৌড় প্রতিযোগিতা হবে কিন্তু গলা কেটে দেওয়ার পর। বাকি বন্দীরাও নিজেদের মৃত্যুর আগে এই নৃশংস ঘটনার সাক্ষী হতে চাইল। যথাসময়ে তাদের গলা কেটে দেওয়া হল, দুজনের গলা থেকেই প্রবল ধারায় রক্ত নিঃসৃত হতে লাগল। মুখ থুবড়ে পড়ার আগে সবেগে কয়েক পা সামনে এগোল, পড়ার সময় হাত দুটো প্রসারিত করল করদোসো কিন্তু সে জানতে পারল না যে তারই জয়।
এই নৃশংস দৃশ্য সবাই উপভোগ করল, এমনকি যাদের কিছু পরেই প্রাণ যাবে, তারাও।
একেবারে নির্মোহভাবে এই গল্প বলেছেন লেখক, কেননা তিনি জানিয়েছেন যে দুঃখের কাঁদুনি গাইতে তিনি চান না। স্বাভাবিক যে তাঁর কোনো গল্প পড়েই চোখের জল আসে না পাঠকের।
প্রতিবেশী দুই শত্রু আমৃত্যু লড়াই করতে করতে তারা যে পরস্পরের দাস হয়ে পড়ে —এটাই প্রমাণ করতেই কি লেখক গল্পটি লিখে ফেললেন না! আর এই আইডিয়াটিকে রূপ দিতে তিনি আনলেন দুজন নির্বোধ কাউবয়, সাদা ও লালপন্থীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ, নৃশংস অধিনায়ক নোলান, গলা কেটে দেওয়ার পরে দৌড় প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।
এখানেই বোর্হেসের গল্পের জাদু, বাস্তব এখানে কল্পনায় নির্মিত। বাস্তব দৃষ্টিতে দেখলে, এই যুদ্ধ বা কাউবয়দের জীবনযাপনের যে ছবি এঁকেছেন তা অবাস্তব নয় কিন্তু তা ন্যাচারালিস্টিক দৃষ্টিতে দেখা বাস্তব নয়, এ হল লেখকের নিজস্ব বাস্তবতা বা Writers Reality, যা নির্মিত হয়েছে তাঁর নিবিড় ইতিহাস জ্ঞান ও কল্পনাশক্তির দ্বারা।
পেরুর নোবেলজয়ী সাহিত্যিক মারিয়ো ভার্গাস য়োসা বোর্হেস নিয়ে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
"শিল্পী এখানে তাঁর পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে সরে গিয়ে বুদ্ধি, পাণ্ডিত্য এবং কল্পনার জগতে আশ্রয় নিচ্ছেন ; রাজনীতি, ইতিহাস এমনকি বাস্তবতার প্রতি হীন দৃষ্টিপাত করেছেন, ...
তাঁর অধিকাংশ গল্পে উদ্ভাবন, আপাত বাস্তবের নির্মাণ, একটা বিসর্পিল পথ অনুসরণ করে, খুঁটিনাটিগুলোকে ঐতিহাসিক পুনর্গঠন ও দার্শনিক এবং তাত্ত্বিক তদন্তের পোশাক চড়িয়ে।"
আমার এই প্রবন্ধের মূল কথাগুলি য়োসা উপরে উদ্ধৃত মাত্র কয়েকটি বাক্যেই বলে দিতে পেরেছেন।
এখানে উদ্ভাবন ও বাস্তবতার নির্মাণ শব্দ দুটি বোর্হেসের সাহিত্যজগৎ সম্পর্কে অত্যন্ত জরুরি। তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সরাসরি কখনোই কিছু লিখতে চাননি, এজন্যই তিনি বারবার উপন্যাসের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে উপন্যাস লেখা যায় না তাই ছোটগল্প ও কবিতাই ছিল তাঁর সৃষ্টির জগৎ।
উপন্যাসকে তিনি খুব উঁচুমানের শিল্পকর্ম বলে মনে করতেন না, কেননা তা বিশুদ্ধভাবে কল্পনাশ্রয়ী নয় —এবিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমাদের মতান্তর হওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু বোর্হেসের মতামত খুবই জোরালো, তিনি বিতর্কিত কিন্তু অনিবার্য।
তাঁর কল্পিত জগৎটা পরিমিত ভাষায় প্রকাশিত বিশুদ্ধ, স্বচ্ছ এবং তা অসাধারণ সব আইডিয়াতে পরিপূর্ণ। এই কথাটি স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়, যদি তাঁর 'নীল বাঘ' বা 'জাহির' ইত্যাদি গল্প পড়ি।
'নীল বাঘ' গল্পে যে চাকতিগুলোর কথা বলেন তা যেন কোনো অলৌকিক জগৎ থেকে আসা ; আসলে আমাদের বাস্তব জগতের পরিমাণ, সংখ্যা বা হিসাবের ধারণার বাইরে যে কিছু থাকতে পারে —এমনই একটা তত্ত্বকে খাড়া করতে লেখক গল্পটি নির্মাণ করেছেন এবং তা করতে গিয়ে গল্পের পটভূমি হিসেবে ভারতের গ্রাম, কুঁড়েঘর, পাহাড়কে এঁকেছেন বইপড়া জ্ঞান থেকেই।
বোর্হেস স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তাঁর জীবনে খুব কম ঘটনাই ঘটেছে কিন্তু পড়েছেন বিস্তর। নিৎশের বা শোপেনহাওয়ারের দর্শন থেকে নানা দেশের পুরাকথা, মিথ, মহাকাব্য, এমনকি সঙ্গীত বিষয়েও তাঁর পড়াশোনা ঈর্ষণীয়। ফলে তিনি অধীত জ্ঞান থেকেই অভিজ্ঞতায় পৌঁছাতে চেষ্টা করেছেন এবং এই বিপরীত যাত্রাকে সফল হতে সাহায্য করেছে তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা আর কল্পনাশক্তি।
এটা আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, তাঁর 'ৎলন, উকবার, অরবিস তেরচিয়াস' গল্পে সম্পূর্ণ কল্পনায় গড়ে উঠেছে
আঞ্চলিক উপন্যাসের একটা বিকল্প কাঠামো।
অনুবাদক ঋত্বিক এই গল্পটি সম্পর্কে বলেছেন,
"ঐশ্বরিক বিধি এবং অতীত উপেক্ষা করে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তি দ্বারা সম্পূর্ণ নতুন এক ব্যবস্থা ও বাস্তব গড়ে তোলার কেন্দ্রীয় ভাবনাটি আমাদের আশ্চর্য করে। পরিচিত দুনিয়ার সাথে সেই দুনিয়ার সংযোগ বা সংঘাত কেমন হতে পারে তার দেখা পাওয়া যায় এই লেখায়।... মেটাফিজিক্যাল কল্পকাহিনির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ এই লেখা।"
এটা সত্যিই যে, তাঁর অধিকাংশ গল্পেই আপাত বাস্তবের নির্মাণ অনেকটা ইতিহাসের পুনর্গঠন করা এবং তার সঙ্গে সুচতুর ভাবে মিশিয়ে দেন দার্শনিক ছদ্মবেশ।
এখানে বোর্হেসের গল্প বলার ভঙ্গি নিয়েও দু'একটি কথা বলা উচিত। এইক্ষেত্রে তিনি বিশ্বের আধুনিক গল্পের একজন ব্যতিক্রমী স্রষ্টা। বোর্হেস গল্প বলতে শুরু করেন, একেবারে রূপকথার গল্প বলার মতো করে, আমরা যারা শৈশবে দাদু ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছি, সেই স্মৃতি মনে পড়বে। যেন অনেকটা দূর থেকে খুব শান্তভাবে সুতোগুলোকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, কিছুক্ষণ পরেই পাঠক (বোর্হেস যেন গল্প শোনান) আবিষ্কার করবেন, লেখক একটা বড়ো জালের ভেতর তাকে পুরে ফেলেছেন,
সুতোগুলোকে এক এক করে ছাড়াতে হবে যদি মূল গল্পের ভেতরে প্রবেশ করতে চান পাঠক।
অন্তত একটি উদাহরণ দিই, যাতে তাঁর পাঠককে কব্জা করার মুন্সিয়ানাটা একটু আধটু অনুমান করা যায়।
'মধ্যবর্তিনী' গল্পের শুরুর কয়েকটি বাক্য তুলে দিচ্ছি :
"লোকে বলে, নেলসনের ছোট ভাই এদোয়ার্দোই প্রথম বড় ভাই ক্রিশ্চিয়ানের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে গল্পটা বলেছিল।
মোরোন জেলার শহরতলিতে, নব্বই দশকের কোন এক সময়ে ঘুমের মধ্যে মারা গিয়েছিল ক্রিশ্চিয়ান।
এখন স্মৃতিতে অস্পষ্ট সেই দীর্ঘ রাতে মাতে-র(প্যারাগুয়ের চা) কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্পটা একজন আরেকজনকে বলেছিল, আবার কেউ একজন বলেছিল সান্তিয়াগো দাবোভকে। তার কাছ থেকেই আমার শোনা। কয়েক বছর পরে, ঘটনাটা যেখানে ঘটেছিল, সেই তারদেরায় গল্পটা আবার শুনলাম। দ্বিতীয়বারের বিশদ বর্ণনা, সাধারণ ছোটখাটো অমিল ছাড়া, সান্তিয়াগোর গল্পের খুব কাছাকাছিই গেল। আমার মনে হয়, গল্পটা শতাব্দী শেষের আগের বুয়েনোস আইরিসের শহরতলির পোড় খাওয়া কিছু মানুষের দুঃখময় জীবনের ছবি, আর তাই এটা লেখা। কোনো অবান্তর কিছুর অবতারণা না করেই গল্প বলার ইচ্ছে আমার, কিন্তু কোনো বিষয়ে জোর দেওয়া বা কোনো বিশেষ বর্ণনা যোগ করার ব্যাপারে লেখকের যে প্রবণতা থাকে আমারও তা হবে, আগেই বুঝতে পারছি।"
নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, গল্পটি বলা এখনো শুরুই করেননি বোর্হেস অথচ শুরুর এই বাক্ নৈপুণ্যে পাঠককে গ্রাস করে নিতে শুরু করেছেন।
গল্পটা পড়তে পড়তেও আপনাকে মনে করতে হবে যে, আসলে তিনি গল্প শোনাচ্ছেন।
আর তাঁর গল্প শোনা মানেই একটা নতুন জগৎকে আবিষ্কার করা, সেই জগৎ হয়তো আপনি কখনো দেখেননি এবং দেখবেনও না অথচ সেই জগৎকে কল্পনায় ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব। হ্যাঁ, একটুখানি বুদ্ধির পরিমার্জনা দিয়ে বিশুদ্ধ শিল্পের প্রতি আগ্রহ দিয়ে সেই অসম্ভব বাস্তবটাকে দেখা সম্ভব।
বোর্হেস সেই সম্ভাবনাকে সৃষ্টি করেছেন।
ঋণ :
১/ খোর্খে লুইস বোর্খেস, মূল স্প্যানিশ থেকে বারোটি গল্পের বাংলা রূপান্তর —অনুবাদ : ঋত্বিক
২/ইত্যাদি ও অন্যান্য গল্প, মূল স্প্যানিশ থেকে বোর্খেসের গল্পের বাংলা রূপান্তর —অনুবাদ : ঋত্বিক
৩/ডক্টর ব্রডির প্রতিবেদন ও অন্যান্য গল্প, হোর্হে লুইস বোর্হেস — অনুবাদ : মেহবুব আহমেদ
৪/'A Writers Reality' — মারিয়ো ভার্গাস য়োসা