সন্ধ্যামণি ও উদ্ধারণপুর : আমার চোখে তারাশঙ্করের গল্পভুবন

তারাশঙ্কর শ্মশানঘাট গল্পটি লিখেছিলেন কন্যা সন্ধ্যা তথা বুলুর মৃত্যুর অভিঘাতে। এই গল্পে উদ্ধারণপুর শ্মশানঘাটের বর্ণনা রয়েছে। বীরভূমের কন্যা নীতা সেই শ্মশানঘাট দেখার সূত্রে পড়লেন তারাশঙ্করের এই গল্পটিকে।

১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য তারাশঙ্করের কারাদন্ড হয়। কারাগার থেকে মুক্তির সময় রাজনৈতিক দলাদলির প্রতি কিছুটা বীতশ্রদ্ধ হয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসে শুধুমাত্র সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করবেন। কারাগারে বসেই তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস লেখা শুরু করেন। এর পূর্বে ১৯২৮ সালে কালিকলম পত্রিকায়, ‘শ্মশানের পথে’ নামে তাঁর একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গল্পটির একটি পরিপূর্ণ রূপ তিনি দিয়েছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’তে। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে।

১৯৩২ সালে তারাশঙ্করের চতুর্থ সন্তান তথা দ্বিতীয় কন্যা সন্ধ্যা মারা যায়। সন্ধ্যার ডাক নাম ছিল বুলবুল বা বুলু। সেই সময় তারাশঙ্কর বেশ আর্থিক সংকটে ছিলেন। শেষ মুহূর্তে আত্মীয়ের কাছে প্রাপ্য টাকা চেয়েও পান নি। মাত্র ছয় বছরের বালিকা ম্যালেরিয়ায় ভুগে মৃত্যুবরণ করে হেমন্তের এক রাতে। যে রাত্রি সম্পর্কে তারাশঙ্কর বলেছেন, ‘এ রাত্রি কোনকালে শেষ হবে না।’

বুলুর মৃত্যুর আগে কংগ্রেস ত্যাগ করে তারাশঙ্কর দিনের পর দিন ভবঘুরের মতো পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। গ্রামে গ্রামে, মেলায় মেলায় ঘোরা তাঁর নেশায় পরিণত গিয়েছিল। সেই সময় তিনি নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। তাদের মধ্যে চোর, ডাকাত, চন্ডাল, বিলাসব্যসনে ডুবে থাকা অন্তঃসারশূন্য শৌখিন লোক এবং কোমল মনের দয়ালু মানুষ সবই ছিল। মেয়ের মৃত্যুর দিন পনেরো আগেই তিনি গিয়েছিলেন উদ্ধারণপুরে গঙ্গার ঘাটে। সেখানকার বিচিত্র পরিবেশ পুঙ্খ্যানুপুঙ্খ্যভাবে পর্যবেক্ষণ করে একটি গল্পের সূত্রপাত করেছিলেন। চমকিত হয়েছিলেন শ্মশানের চন্ডালের মুখে যখন শুনেছিলেন একটি দার্শনিক পঙক্তিঃ

‘আমার মনের চিতে নিভল না।

দেহের জ্বালা জুড়ালোরে চিতের আগুনে,

আমার মনের চিতে নিভল না।’

মেয়ের মৃত্যুর পর নিজের মনের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তারাশঙ্কর ‘আমার সাহিত্য জীবন’ এ লিখেছেন,

‘আমার সমগ্র জীবনে এই আঘাত একটা পরিবর্তন এনে দিলে। জীবনপ্রবাহের মোড় ফিরে গেল। আমার জীবনে চলার পথে যে দু-নৌকায় দু-পা রেখে চলা, তাতে ছেদ পড়ল। একখানা নৌকাকেই আশ্রয় করে হাল ধরলাম। এই মর্মান্তিক আঘাত না এলে বোধ হয় তা হত না। এবং জীবনে এই বেদনার সুগভীর সমুদ্রে যদি না পড়তাম, তবে বেদনা-রসকে উপলব্ধিই করতে পারতাম না।’ 

যে তারাশঙ্কর তাঁর আট বছর বয়সে একটি পাখির ছানার মৃত্যু ও পক্ষিমাতার আকুল ক্রন্দন শুনে বাড়ির দেওয়ালে খড়ি দিয়ে জীবনে প্রথম ছড়া লিখেছিলেন, সেই তারাশঙ্কর কন্যা-বিয়োগের বেদনায় নির্মাণ করলেন ‘শ্মশানঘাট’ নামে একটি ছোটগল্প। যার প্রথম অংশটি উদ্ধারণপুরের ঘাটের দৃশ্যাবলী বর্ণনা করে পূর্বেই লিখে রেখেছিলেন। বুলু যদি না মারা যেত, গল্পের শেষ অংশটুকু হয়ত অন্য কিছু হতো, একথা তিনি নিজেই বলেছেন।

বুলু যেদিন মারা যায়, তার পরদিন উদভ্রান্ত তারাশঙ্কর কাজের অজুহাতে চলে যান কলকাতা। সেখানে ‘উপাসনা’র অফিসে গিয়ে দেখেন উপাসনা উঠে যাচ্ছে এবং সাবিত্রীপ্রসন্ন বিদায় নিচ্ছেন। ওখানে তৈরি হবে বঙ্গশ্রীর অফিস এবং সজনীকান্ত তার হাল ধরবেন। অবসন্ন তারাশঙ্কর যেন নিজের অজ্ঞাতসারেই ফিরে আসেন লাভপুরে। ‘শ্মশানঘাট’ গল্পটি সজনীকান্ত সম্পাদিত বঙ্গশ্রী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালের মাঘমাসে। গল্পটি পরবর্তীকালে ‘সন্ধ্যামণি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।

(২)

একেবারে ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের অঞ্চলে গঙ্গাস্নানে যাওয়া ব্যাপারটা কেমন অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ছিল। গঙ্গাস্নানে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য সংসারে শুচিতা বজায় রাখা। সকলের বাড়িতে গৃহদেবতা আছে। গৃহদেবতার নিত্যপুজোয় হাত লাগাতে গেলে শুচিতা রক্ষা করা অপরিহার্য। পূর্ণিমার দিন সত্যনারায়ণ পুজো, বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপুজো ছাড়াও পঞ্চমী, ষষ্ঠী কোনও তিথিতেই পুজো বন্ধ নেই।

এক একটি পরিবার তাদের জ্ঞাতিগুষ্টি মিলিয়ে নেহাত ছোট ছিল না। তাই বৃহৎ সংসারের জন্মমৃত্যুর লীলাখেলার সঙ্গে সঙ্গে আপন পারিবারিক গণ্ডীতেও জন্ম-মৃত্যু লেগেই থাকত। জ্ঞাতিকে আমাদের অঞ্চলে বলা হয় ভায়াদ। ভায়াদদের মৃত্যুতে অশৌচ, সম্পর্কবিহীন প্রতিবেশীর মরদেহ ছুঁলেও দেহ অশুচি। আবার নিজের পরিবারে অথবা ভায়াদের শিশু জন্মালেও অশৌচ। সেই অশৌচ কাটাতে হয় গঙ্গায় অবগাহন করে। এছাড়াও ছিল পুণ্যতিথিতে গঙ্গাস্নান, বিশেষ করে সংক্রান্তিতে। মোদ্দা কথা হল, গঙ্গাতীরে বাস না হলেও গঙ্গাস্নানের প্রয়োজন ছিল অনস্বীকার্য।

গঙ্গাস্নানে যাওয়ার জন্যে আমাদের নিকটতম স্থান ছিল উদ্ধারণপুর। পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার নিকটবর্তী স্থান। আমাদের গ্রাম থেকে আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার দূর। উদ্ধারণপুরের ঘাটে স্নান হল পুণ্যস্নান। বর্ধমান ছাড়াও মুর্শিদাবাদ এবং বীরভূমের দূরদূরান্তের গ্রামগুলি থেকে সারা বছর স্নানার্থী এখানে আসতেই থাকে।

ঠাকুমার গঙ্গাস্নানে যাওয়া আমাদের কাছে ছিল তীব্র আকর্ষণের বিষয়। চৈত্র সংক্রান্তি আর দুর্গাপুজোর সময় ছাড়াও জন্মমৃত্যু ঘটিত কারণে বছরে বার কয়েক গঙ্গাস্নানে যায় ঠাকুমা। তবে একা যায় না। পাড়ায় অথবা আত্মীয়বাড়িতে খবর নেওয়া হয় প্রথমে, কে কে যাবে! তারপর একটা দল তৈরি হয়। একদিকে প্রৌঢ়াদের দল গড়ে ওঠে আর একদিকে স্ব স্ব বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যরাও দল পাকায়। তারপর নাকিসুরে বায়না ধরে ‘আমি তব হব সাথী’। গোরুর গাড়ি জুড়লে, আগেভাগে গিয়ে জায়গা দখল করে বসে থাকে সব। অতঃপর যাত্রাকালে একটি খণ্ডযুদ্ধ বাঁধে। একদল নাতিনাতনি সঙ্গে নিয়ে পুণ্যস্নান করতে যাওয়া ঠাকুমাদের কাছে বিভীষিকা। শেষপর্যন্ত একজনের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। আর বাকিদের নানারকম লোভ দেখানো হয়। ‘পরের বার তোকে নিয়ে যাব’ কথা দিয়ে ক্রন্দনরত শিশুকে পেছনে ফেলে ঠাকুমাদের দল চলে যায়। প্রত্যেক প্রৌঢ়ার সঙ্গে একটি করে ল্যাংবোট। যারা যেতে পারল না, তারা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে একটা সময় অপেক্ষা করতে শুরু করে। তাকিয়ে বসে থাকে রাস্তার দিকে, ঠাকুমা কখন ফিরবে! ফেরার সময় কাঠের পুতুল, মাটির হাঁড়িকুঁড়ি কিছু না কিছু নিয়ে আসবে।

উপহার পেয়ে মন ভরে থাকলেও যে স্বয়ং গঙ্গাস্নানের সৌভাগ্য অর্জন করেছিল তার আর গল্প ফুরোতে চায় না। গঙ্গাচানের নিয়মকানুন, গঙ্গার ঘাটের হরেক রঙ্গ, কটা নৌকা দেখেছে, কতবার শুশুক দেখেছে, কী কী খেয়েছে সেসব বিবরণ দিয়েই যায় সে। যে শিশুটি স্নানে যাওয়ার সুযোগ না পেয়ে সামান্য উপহারে সন্তুষ্ট হয়েছিল, ঠাকুমার পরবর্তী গঙ্গাস্নানে সঙ্গী না হওয়া পর্যন্ত সে শান্তি পায় না।  

(৩)

একদিন আমার ভাগ্যেও শিকে ছেঁড়ে। ঘরের বাইরে দুপাশের দৃশ্য আমি তৃষ্ণার্তের মতো শুষে নিই। দেখি আর স্মৃতির ভাড়ারে সঞ্চয় করে রাখি। ঠাকুমাকে বিশেষ বিরক্ত করি না।

সেবারে মহেশপুর পর্যন্ত গোরুর গাড়িতে যাওয়া হল। ওখান থেকে বাসে কীর্ণাহার। তারপর বাস বদল। কীর্ণাহার থেকে উদ্ধারণপুরের দূরত্ব ৩১ কিলোমিটার। পুবমুখী রাস্তা আমোদপুর- কীর্ণাহার- রামজীবনপুর রোড। কীর্ণাহার ছাড়িয়ে কলগাঁ (দাশকলগ্রাম), ফুটিসাঁকো, কাঁদরা, কোমরপুর, নিরোল ইত্যাদি জায়গায় বাস থামে। ঠাকুমার বাবা কীর্ণাহারে বসবাস করলেও তাঁর আদি নিবাস ছিল এই দিকে কৈচর নামে একটি গ্রামে। ঠাকুমার দুইবোনের শ্বশুরবাড়ি এদিকটায়। তাই ঠাকুমার মুখে নামগুলি বারেবারে শোনা। পাচুন্দির কাছে রাস্তা দুভাগ হয়ে একটি চলে যায় কেতুগ্রামের দিকে আর একটি উদ্ধারণপুরের দিকে। তারপর আসে গঙ্গাটিকুরী। বর্ধমান থেকে রেলপথে বোলপুর গেলে যেমন অনেকগুলি ঢাল আছে তেমনি আমাদের চেনা গণ্ডিতে অনেকগুলো টিকুরী ছিল। তিলটিকুরী, ঢোলটিকুরী, কাপাসটিকুরী, বিপ্রটিকুরী ও গঙ্গাটিকুরী। গঙ্গাটিকুরীর অনতিদূরেই উদ্ধারণপুর।

শৈশবে দেখা উদ্ধারণপুরের গঙ্গার ঘাট আমার স্মৃতিপটে যেন একটা দীর্ঘস্থায়ী ছবি তৈরি করে দিয়েছিল। বহুদিন পর্যন্ত গঙ্গার ঘাট বলতে আমি উদ্ধারণপুরের ঘাটের ছবিই ভেবেছি। যতবার গঙ্গাস্নানের বর্ণনা পড়েছি কোনও লেখায় ঐ ঘাটের দৃশ্যই ভেসে উঠেছে মানসপটে।

বাস থেকে নেমে খানিকটা হাঁটতে হল। স্নানের ঘাটে পৌঁছনোর আগে রাস্তার দুপাশে দোকানপাট শুরু হল। মেলার মতো। কিছু দোকান সাংসারিক জিনিসপত্রের। হাতা, খুন্তি, বেড়ি, কড়াই। কিছু খেলনাপাতির দোকান। মাটির পুতুল, হাতি-ঘোড়া ছাড়াও মাটির ছোট ছোট বাসনপত্র। কলসি, কুঁজো, ভাঁড়, সরা, হাঁড়ি এইসব। এছাড়া নানা মাপের মাটির প্রদীপ পাওয়া যায়। গ্রামেগঞ্জে তো হাতের কাছে বাজার নেই। তাছাড়া হাটেবাজারে বাড়ির মেয়েদের যাওয়ার তেমন চলও নেই, তাই ঐ দোকানগুলিতে স্নানার্থীরা থামেন। কাঠের পুতুল, খেলনা গাড়িরও দোকান আছে। কাপড়ের দোকানে বাচ্চা মেয়েদের জন্যে ছোট ছোট শাড়ি ঝুলছে। ময়রার দোকানের লোকটা একটানা মণ্ডা-বাতাসা গুনে চলেছে। চান করে লোক ভিড় করছে খাবারের দোকানে। চপ, ঘুগনি, লুচি তরকারি আর চায়ের দোকান। দুপাশের দোকান থেকে পথচারীদের ডাকাডাকি করছে। এই লোকগুলোকে বলে ‘ডেকো’। ওরা পারলে টেনে দোকানে ঢুকিয়ে দেয়। রাস্তার ধারে চট পেতে বসে আছে কানা খোঁড়া রুগ্ন ভিখারির দল।

ঠাকুমা বাড়ি থেকে খুচরো পয়সা আর চাল নিয়ে এসেছে। ভিখারিগুলো সামনে বাটি পেতে রেখে ভিক্ষা চাইছে। তাদের বাটিতে মুঠো মুঠো চাল দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে ঠাকুমার দল। আমি ঠাকুমার কথামতো ওঁর শাড়ির খুঁটটা চেপে ধরে রেখেছি। সঙ্গছাড়া হয়ে গেলেই ছেলেধরাতে ধরবে। মিষ্টির দোকানে মণ্ডা কিনে ঠাকুমার দল গেল কলাওয়ালার কাছে। কলা বলল না, বলল গঙ্গাফল।

রাস্তাটা শেষ হল বিরাট এক বাঁধানো ঘাটের সামনে। ঘাটের পাশে বিশাল অশ্বত্থগাছ। গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে সম্মুখে তাকালে পূর্বদিক। সূর্যের দিকে মুখ করেই গঙ্গায় স্নান করা নিয়ম। ছোট ছোট নৌকা ভেসে আছে গঙ্গার বুকে। কোনটা চলে যায় দক্ষিণে, কাটোয়া। ওখানে আছে নামকরা সাধুবাবার আশ্রম। অনেকেই স্নান সেরে নৌকা চেপে কাটোয়া যায়। সাধুর আশ্রমে দুপুরের ভোগ খায়। ওখানকার বাজার বড়। কেনাকাটা করে ওখান থেকেই ফেরার বাস ধরে।

চান করার সময় ঠাকুমা হাতে একটা মণ্ডা, একটা কলা আর চার আনা পয়সা দিয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে হাত ধরে ধরে নামায়। বলে, ‘ওইগুলো মা গঙ্গাকে দিয়ে প্রণাম কর।’ আমিও সব ছুঁড়ে দিই গঙ্গার জলে। তারপর নাক কান চেপে ডুব দিই। ঠাকুমা বলে, ‘কম করে তিনটে ডুব দে।’

ঘাটে দেখি একটি পরিবার বেশ জাঁকজমক করে বসে আছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে গঙ্গাচানের। সঙ্গে একটা কচি শিশু, ঘুমন্ত। ঠাকুমারা আলোচনা করে, বাচ্চার প্রথম গঙ্গাচান। এরপর ছেলের ভুজনো (মুখেভাত) হবে। ভুজনোর আগে মা, বাচ্চা সবাইকে শুদ্ধ হতে হয়। বাচ্চাটার মা একটা ছোট পুঁটুলি গঙ্গায় ফেলে দিয়ে প্রণাম করল। জানতে পারি রুমালের মতো একফালি কাপড়ে বাঁধা ছিল সাতটা কুল আর এক মুঠো ধনে। ছেলের নাম করে মাগঙ্গাকে সাতটা কুল দিলে, মাগঙ্গা আশীর্বাদ করে। ওই ছেলে সাতকুলের মানমর্যাদা রক্ষা করবে। আর ধনে দিলে, ঐ ছেলের সংসার ধনেসম্পদে উথলে উঠবে।

ঘাটের বাম দিকে সামান্য এগিয়ে গেলেই শ্মশানঘাট। ঐ শ্মশানঘাট প্রায় কাশীর মণিকর্ণিকার ঘাটের সমতুল্য। সেকালে অন্তর্জলিযাত্রায় যেত লোকে, ওখানেই। চিতা ওখানে সারাদিনরাত জ্বলে।  উদ্ধারণপুরের খ্যাতি শুধুমাত্র স্নানঘাট হিসেবেই নয়, শ্মশানঘাটের জন্যেও বটে। জনশ্রুতি, শ্রীচৈতন্যদেবের পার্ষদ উদ্ধারণ দত্তের নামে এই ঘাট। আমাদের অঞ্চলে আজও ঘটা করে বৃদ্ধবৃদ্ধার মৃতদেহ নিয়ে গঙ্গা দিতে যাওয়া হয়। ছোটবেলায় দেখেছি কাঁধকেটো (শ্মশানবন্ধু)রা অতটা রাস্তা হেঁটে  হেঁটে মাকোশাং (কাঁচা বাঁশের তৈরি খাট)এ করে কাঁধে মড়া বয়ে নিয়ে যেত। পরের দিকে অবশ্য ট্রাক ভাড়া করে যাওয়ার চল হয়েছে। তখনও কিছু মার্কামারা কাঁধকেটো আমাদের ছোটবেলার মতো আগেভাগে ট্রাকে উঠে বসে পড়ত সেই ‘আমি তব, হব সাথী’ ভঙ্গীতে। গঙ্গার ধারে না গিয়ে কোপাই বা ময়ূরাক্ষীর তীরে দাহ করলে পরিবারের বদনাম হতো। পরিবারের লোকেও অপরাধবোধে পীড়িত হতো।  

(৪)

তারাশঙ্করের ‘সন্ধ্যামণি’ গল্পটি শুরু হয় গঙ্গার তীরে স্নানঘাটের অপূর্ব বর্ণনা দিয়ে। ‘হিন্দু আমলের অক্ষয়পুণ্য-মহিমান্বিত একটি স্নানঘাট। গঙ্গা এখানে দক্ষিণ-বাহিনী। রাঢ়ের বিখ্যাত বাদশাহী সড়কটা বরাবর পূর্বমুখে আসিয়া এই ঘাটেই শেষ হইয়াছে।’ গল্প এগিয়ে যায় যেন জীবনগাঁথার কথা বলতে বলতে। ওই স্নানঘাট ঘিরে যে মানুষগুলি জীবিকানির্বাহ করে তাদের কথা ফুটে ওঠে। কেউ ফল বিক্রি করে, কেউ পান বিড়ি বিক্রি করে, কেউ মিষ্টি, কেউ আবার খেলনা দ্রব্য। এর সামান্য দূরেই শ্মশানঘাট। জীবনের আরও একটি সমান্তরাল প্রবাহ চলে সেই শ্মশানঘাটে। বীভৎস সেই দৃশ্য। সেখানে অবিরল ধারায় মৃতদেহ আসে। ‘বলহরি, হরি-বো-ল’ ধ্বনি বাজার পেরিয়ে শ্মশানের দিকে বেঁকে যায়। বাজারের কর্মকাণ্ডে ক্ষণেক ছেদ পড়ে। তারপর আবার চলতে শুরু করে ছন্দে। শ্মশানরক্ষী নিরন্তর তার কাজ করে যায়। মৃতের লেপ তোশক সংগ্রহ করে, কাপড়চোপর খুলে নেয়, চিতায় কাঠ সাজায়, আগুন জ্বালায় আর আঙার ফিরিয়ে দেয়। 

জায়গাটি লেখকের বর্ণনায় ফিরে আসে তার সান্ধ্যকালীন রূপ নিয়ে। সন্ধ্যে মানেই জনজোয়ারে ভাটা। ব্যস্ততা কম। দোকানদারেরা হিসেব নিয়ে বসে। জমিদারের খাজাঞ্চী খাজনা আদায় করতে বের হয়। কুমোরবুড়ো মাটির পুতুল তৈরি করে। ছকু বিড়ি বাঁধে। গল্পের অন্যতম মূল চরিত্র কুসুম মাদুর বোনে। বৃদ্ধ পাল উপকথা শোনায়। মজলিশ চলে, হাতও চলে।

যেন স্থানটির একদিকের চিত্র আঁকা হয়েছে এক মায়াময় তুলির টানে। সে ছবি সৌন্দর্যে ভরপুর। পরক্ষণেই চলে যেতে হয় ছবির অন্যদিকে। যেমন দিনের উলটোপিঠে রাত, যেমন আলোর ওপাড়ে অন্ধকার। এক ধূসর জগত উঠে আসে সেই চিত্রে। যেন লেখক জীবনের এপিঠ ওপিঠ দুটোকেই দেখাচ্ছেন নিরপেক্ষ ও নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে। সেই চলমান জীবনের মাঝখান থেকেই বেরিয়ে আসছে কাহিনি। কুসুম ও তার বাউন্ডুলে স্বামী কেনারাম চাটুজ্জের কথা। কেনারাম সংসারের প্রতি মায়া ত্যাগ করেছে। তার শিশুকন্যার মৃত্যুর কারণেই তার এমন বিরাগ। কুসুমের প্রতি আকর্ষণ ছিন্ন করতেও সে যেন বদ্ধ পরিকর। গ্রামে গ্রামে, মেলায় মেলায় ঘুরে নিজের গ্রামে পৌঁছেও কুসুমের কাছে ফেরে না সে। কুসুম একবুক আশা নিয়ে দরজা খুলে রাখে। কেনারাম ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে চলে যায় শ্মশানঘাটে।

যে শ্মশানঘাটকে লেখক বর্ণিত করেছেন, ‘স্নানঘাটের উত্তরে কিছু দূরে আর এক ফালি পায়ে-চলার পথ গঙ্গার গর্ভমুখে নামিয়াছে। ইহার দু’ধারে বুকভরা উঁচু আগাছার জঙ্গল। মাথার উপরে বড় বড় গাছের শাখা-প্রশাখা আকাশ ছাইয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে। স্থানটার একটা তীব্র বিকট গন্ধে বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় খাইয়া উঠে। দগ্ধ নরদেহের গন্ধ। এইটিই শ্মশানঘাট।’

কেনারাম পৌঁছয় শ্মশানের চন্ডাল পৈরুর ডেরায়। চিতার কাছেই পৈরু তার শিশুকন্যা ও একপাল কুকুরের সঙ্গে বসবাস করে। কেনারাম দেখে, চিতায় দশবারো বছরের একটি বালিকার দেহ। পৈরু কাঠ সাজিয়ে চিতা জ্বালিয়ে নিজের কাজ করে। মেয়ের গায়ে চাদর টেনে দেয়, ঘর ঝাঁট দেয় এমন কি হাত ধুয়ে খেতেও বসে। চিতার আগুন নিভুনিভু হলে খেতেখেতেই উঠে যায়। গিয়ে আঙরা ঝেড়ে আগুন উসকে দিয়ে আসে। একটি শব দাহ হতে না হতেই চলে আসে পরবর্তী শব। হয়ত দশ বছরের বালিকার পরের মৃতদেহ একটি পক্ককেশ বৃদ্ধের। পৈরু আবার চিতার উপর কাঠ সাজায়। শববাহকেরা, শবদেহ তুলে দেয় চিতার উপর। চিতা জ্বেলে দিয়ে পৈরু আবার তার নৈমিত্তিক কাজ করে।        

আরও একটা নতুন সকাল আসে। স্নানঘাটের রূপ আবার বদলে যায়। গঙ্গার বুকে নৌকা বয়। দলে দলে স্নানার্থী আসে। দোকানগুলো গমগম করে। ভিখারিরা লাইন দিয়ে বসে পড়ে রাস্তার ধারে ধারে। দুপাশের বাজারে বিকিকিনি চলে। গল্প শেষ হয় এক নতুন সম্ভবনার বার্তা দিয়ে। কেনারামের খুকু যে সন্ধ্যামণি গাছখানি পুঁতেছিল তাতে ফুল ফুটে ওঠে।

আমার শৈশবে দেখা সেই গঙ্গার ঘাট অবিকল দেখতে পেয়েছি সন্ধ্যামণি গল্পের শুরুতে এবং শেষে। সে ঘাট আমি যতবার দেখেছি, দেখেছি দিনের আলোয়। তাতে মেলা দেখার মতো নির্ভেজাল আনন্দ ছাড়া আর কিছু ছিল না। যেন শিশুর আঁকা রংবেরঙের একটা ছবি। গল্পের বাকি অর্ধেকটা চাক্ষুষ করি নি। তবে কর্ণগোচর হয়েছে। মাঝেমধ্যে বাড়িতে সান্ধ্য মজলিশে পাড়ার কাকাজেঠাদের মুখে ওদের অনেক অভিজ্ঞতার কথা শুনতে পেতাম। তাঁরা রসিয়ে রসিয়ে নানা ধরণের গল্প বলতেন। তাঁদের মুখে ভূতের গল্প শুনেছি, চোরডাকাতের গল্প শুনেছি আর শুনেছি মড়া পড়ানোর গল্প। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল মার্কামারা কাঁধকেটো। তাঁদের সঙ্গীরা অনেকেই ছিল মায়ে তাড়ানো, বাপে খেদানো, অকর্মণ্য এবং নেশাড়ু। গাঁয়ে কেউ মরলেই কোমড়ে গামছা বেঁধে তারা হাজির। ওঁদের গোপন উদ্দেশ্য ছোটবেলায় না জানলেও বড় হয়ে জেনেছি। সৎকারের পারিশ্রমিক হিসেবে খাবার এবং মদ ও গাঁজার নেশার জন্যে পয়সাটা আগেভাগে মৃতের পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা।

ওখানেই শুনেছি মড়া পোড়ানোর বিবরণ। কী নির্লিপ্ত বর্ণন! যেন খাওয়া বা ঘুমনোর মতো সহজ কোনও বিষয়ে কথা বলছে। কখনও বলছে, ‘লোকটা পুণ্যবান ছিল। ফার্স্টক্লাস পুড়ল, কোনও ঝামেলা করে নাই।’ কখনও আবার বলছে, ‘শালা, বেঁচে থাকতে যেমন জ্বালিয়েছে, মরেও তাই। পুড়তেই চায় না, যেন শরীর ভর্তি জল! বাঁশ দিয়ে বেড়িয়ে বেড়িয়ে হাতের সুখ করে নিয়েছি। বেঁচে থাকতে তো পারি নাই। ক’ঘা মারব বলেই গিয়েছিলাম পোড়াতে।’

শবদাহ সম্পর্কে আরও জ্ঞান লাভ করেছি। ‘মানুষ যেমন উলঙ্গ আসে, তেমনি উলঙ্গ ফিরে যায়। চন্ডাল নিয়ে নেয় তার বিছানা ও কাপড়।’ পুড়ে যাওয়ার পর চিতাভস্ম বিসর্জন করে ওরা ঘর ভাড়া করে। মাছ অথবা মাংস ভাত রান্না হয়। তারপর মদ গাঁজা খেয়ে বিশ্রাম। শরীরের ক্লান্তি কাটলে তবে ফেরা। ঘরে ঢোকার পূর্বে তাদের হাতে এক ভাঁড় রাজভোগ ধরিয়ে দিতে হয়। এ সবই নিয়ম।

শুনে খটকা লাগত। একজন মানুষকে শেষ বিদায় জানাতে গিয়ে এভাবে পিকনিক করতে পারে মানুষ? এমন নির্দয় ব্যবহার করে যার সদ্য আত্মীয়বিয়োগ হয়েছে সেই পরিবারটির সঙ্গে! খটকার একটা উত্তর অনেক বছর পরে একজন বয়স্ক মানুষের কাছে পেয়েছিলাম। এক নিঃসন্তান ব্যক্তির মৃত্যুবাসরে তিনি বলছিলেন, ‘ওদের মধ্যে একজন না একজন থাকেই, যে এসবের মধ্যে থেকেও থাকে না। সবটুকু মায়া পুড়িয়ে দিতে, ভাসিয়ে দিতে পারে না সে। মুখ নামিয়ে বসে থাকে এক কোণায়। আসলে যা কিছু হারানোর, সেই হারিয়েছে। সে হয়ত ঐ মৃতের সন্তান অথবা নিকট কোনও মানুষ। আহা এর জন্যে নিঃশ্বাস ফেলার মতো কেউ যে নেই!’

ছোটবেলার স্মৃতি থেকে লেখা শুরু করেছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, উদ্ধারণপুর আজও একই রকম। স্নানঘাট বা শ্মশানঘাটের কোনও পরিবর্তন হয় নি। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাটোয়ায় বৈদ্যুতিক চুল্লি স্থাপিত হলেও উদ্ধারণপুরে সেই একই দৃশ্য। চিতার পাশেই স্তুপ হয়ে জমে ওঠে বাঁশ, মৃতের লেপ তোষক। মৃতদেহকে একই রকম নির্মম প্রহার করা হয় দাহ করার সময়। মৃতদেহ পুড়ে ছাই হবার আগেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে আধপোড়া দেহাংশ ফেলে দেওয়া হয় গঙ্গার জলে। আজও বহু মানুষ উপযাচক হয়ে কাঁধকেটো হয়। দাহ করতে যাওয়ার আগে তারা রীতিমতো দর কষাকষি করে মদ, গাঁজা এবং মাংস খাওয়ার পয়সা নিয়ে। আজও গেরস্থবাড়ির বৃদ্ধবৃদ্ধাদের গঙ্গার তীরে দাহ না করলে পরিবারের দুর্নাম হয়। বৈদ্যুতিক চুল্লির উপযোগিতা বুঝে, পরিবেশ দূষণের কথা মাথায় রেখে কাটোয়ায় দাহ করলে নতুন বিবাদ সৃষ্টি হয়। ‘উদ্ধারণপুরের মতো অক্ষয়পুণ্য ঘাট থাকতে কাটোয়া কেন?’