মহানগর- এক মায়াময় নারীবাদী আখ্যান

২০১৬ সালের 'লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা' নামের এক নারীবাদী ছবির নামখানি শুনে ১৯৬৩ সালের 'মহানগর' ছবির পোস্টারের কথা মনে পড়েছিল আমার। সেই পোস্টার, যেখানে মাধবীর দ্বিধান্বিত আয়ত চোখদুটি অনির্দিষ্টে নিবদ্ধ। থুতনিটা ধরে ছিল অন্য একটি হাত, যে হাতের মালিক অদৃশ্য। অদৃশ্য ব্যক্তির অন্য হাতটি একটি লিপস্টিক বোলাচ্ছিল মাধবীর লজ্জিত ঠোঁটে৷

আবার, প্রথম যখন ওই ছবিটি দেখি টিভিতে, তখন মনে পড়েছিল, আমার খুব ছোটবেলায়, মানে আশির দশকের শেষ দিকে, মায়েরও ছিল অমন একখানা লিপস্টিক, গাঢ় লাল। নবোঢ়া মায়ের যেটুকু ছিটেফোঁটা গেরস্তালি মায়ের গায়ে তখনও লেগেছিল, লিপস্টিকটি তারই এক কুচি। সে থাকত ড্রেসিং টেবিলের গোপন অন্তঃকুঠুরিতে। বেশি দিন মাকে তাকে ওষ্ঠাধরে ধারণ করতে দেখিনি। লিপস্টিক পরা ভদ্রবধূজনোচিত ছিল না সেকালে।

এইভাবে 'মহানগর'-এর লিপস্টিক অদ্ভুত 'অবজেকটিভ কোরিলেটিভ' হয়ে নানা দশককে এক সুতোয় গেঁথে ফেলে। লিপস্টিক কি ওই ছবির এক উল্লেখযোগ্য প্রপ ছিল না? চারুলতার ওয়াচগ্লাস হয়ত অবিসংবাদিতভাবে 'ফিমেল গেইজ'-এর  দ্যোতক। তবে 'মহানগর'-এর আরতির লিপস্টিক বড় কম যায় না৷ তাকে ঘিরে আরতির যে দ্বিধা, তা গৃহবধূ ও স্বাধীন নারীর মাঝের দ্বন্ধটিকে চমৎকার ধরেছিল। তখনও লাল লিপস্টিকের নারীর যৌন স্বাধীনতার চিহ্ন হয়ে উঠতে দেরি ছিল। কিন্তু সাফ্রেজিস্ট /সাফ্রেজেটদের লড়াই-এর দিনেও লাল লিপস্টিক শুধু প্রসাধন ছিল না। ছিল নারীর দুর্বিনয় ও স্বাধীনতার প্রতীক। সেই প্রতীক ব্যবহারে সত্যজিতের স্বাচ্ছন্দ্য একবিংশ শতকেও চমকে দেয়।  

 

সত্যজিৎ এই ছবিতে ধরছেন ষাটের দশকের কলকাতাকে, কমিউনিজম যার দোরে কড়া নাড়ছে। তখনও উদ্বাস্তু পরিবারগুলির হাল ফেরেনি। এক নিম্ন মধ্যবিত্ত গেরস্থালি বধূর কর্মরতা নারীতে রূপান্তরের গল্প বলেন সত্যজিৎ। তার জন্য উপাদান সংগ্রহ করেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র-র 'অবতরণিকা' থেকে৷ ছবিটি দেখতে বসে লিঙ্গভিত্তিক কর্ম বিভাজন থেকে শুরু করে বেতনের সমানাধিকার থেকে বিশ্বজনীন ভগিনিত্ব- নানা বিষয়ে এত খুঁটিমাটি 'কমেন্ট' (বাচিক মন্তব্য নয়, ছবির আনাচে কানাচে মিশে থাকা ডিটেলিং) চোখে পড়ে যে, আশ্চর্য হয়ে ভাবি, 'অবতরণিকা'-য় কি ছিল এমনতরো? না এসব সত্যজিতের মস্তিষ্কপ্রসূত?

 

ধরা যাক, প্রথমেই সুব্রত (অনিল চ্যাটার্জি) যখন তার বোনকে বলে, 'পড়ে আর কী হবে, সেই তো বৌদির মতো হাঁড়ি ঠেলতে হবে', তখন আরতির (মাধবী মুখোপাধ্যায়)  কিশোরী ননদটি ( জয়া ভাদুড়ি) জানায়, বই-এও শেখায় ওসব, অর্থাৎ হাঁড়ি ঠেলা। সে 'ডমেস্টিক সায়েন্স'-এর কথা বলে, দুষ্টু হেসে দোর দেয়। কিন্তু আমরা ভাবতে বসি, সত্যজিৎ কি অনায়াসে 'নারীসুলভ সিলেবাস'-এর সমালোচনা করে গেলেন দেড় মিনিটের সংলাপের ওঠাপড়ায়।

 

আরতি যখন চাকরিতে জয়েনিং-এর দিন 'স্বামী'-র পাশে খেতে বসে, সে যেন এক বিয়োগান্তক দৃশ্য। শাশুড়ি খুন্তি নাড়েন কাঁদতে কাঁদতে। পুত্রবধূর কাজে যাওয়াকে তিনি পরম অধঃপাত হিসেবেই দেখেন, বলা বাহুল্য। কিন্তু সেই ননদটি বলে, কতদিন পরে যুগলকে একসাথে খেতে দেখল সে! বিয়ের সময়েই একমাত্র দেখেছিল। মধ্যবিত্ত বাড়িতে পুরুষের খাওয়া হলে নারীর খেতে বসার অলিখিত নিয়মটির বৈষম্য প্রকট করার জন্য সত্যজিৎকে কোনো প্রতিবাদমুখরতার সাহায্য নিতে হয় না৷ বিরল একটি দৃশ্যের প্রতি জয়া ভাদুড়ির মুগ্ধতাই তা আলগোছে অনাবৃত করে।

 

মায়ের চাকরিতে যাওয়া নিয়ে আট বছরের পিন্টুর ক্ষোভ ও তজ্জনিত আরতির দোলাচলটি সবচেয়ে মনোগ্রাহী। পিন্টু ভারি রাগ করে তার মায়ের প্রথম অফিসে যাওয়ার দিনটিতে। আরতি মান ভাঙাতে না পেরে কেঁদে ফ্যালে। আরতিকে কোনো নারীবাদী আইকন হিসেবে গড়ে তোলা রায়ের লক্ষ্য ছিল না। তাই সে গড়পড়তা নারীর মতোই প্রথম অফিসে যাওয়ার দিনটিতে অপরধবোধে ভোগে। পরবর্তীতে পিন্টু অবশ্য খুশি হয় মায়ের দেওয়া খেলনা বন্দুক আর লাট্টু পেয়ে। কিন্তু জ্বর হলে সে আবার অভিমান করে মায়েরই উপর। মায়েরই অনুপস্থিতি কাঁটা হয়ে বেঁধে তার শিশুমনে। সে বলে, 'মা খারাপ, মাকে মারব'। আরতি সহাস্যে সপ্রশ্রয়ে জিজ্ঞাসা করে, 'সেদিন যে খেলনা বন্দুকটা দিলাম, তা দিয়ে মারবে?' মা শিশুর সাবলীল সরস কথোকপথন, অথচ চাকুরিরতার প্রতি সংসারের অকৃতজ্ঞতা নিমেষেই উপস্থাপিত হয়। মুহূর্তেই বোঝা যায়, সামাজিক ইনডকট্রিনেশনের বাইরে নয় শিশুও।  কর্মরতা নারীকে কর্মরত পুরুষের মতো শুধু উপার্জন করলে চলে না। সন্তান আশা করে, সংসার আশা করে যে সে তাদের সেবাতেও নিয়ত নিয়োজিত থাকবে। কোনো চ্যুতি সেখানে ক্ষমার্হ নয়। ষাটের দশকে আরতি এই যেসব সূক্ষ্ম সাংসারিক রাজনীতির সম্মুখীন হয়েছিল, আজও কি নারী তা থেকে মুক্তি পেয়েছে?

এখনও কি একহাতে ল্যাপটপ অন্য হাতে খুন্তি ধারণ করা সাংসারিক দশভুজাই বন্দিত হয় না সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিসরে?

 

ছবির শুরুতে আরতি ছিল কর্তব্যপরায়ণা গৃহবধূ। শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-বর-ছেলে নিয়ে তার টানাটানির সংসার। সুব্রত ব্যাংকের কেরানিগিরি আর টিউশন সত্ত্বেওও সামলে উঠতে পারে না। শ্বশুরের চশমা হয় না, শাশুড়ির সুগন্ধী জর্দা আসে না, ননদের ইস্কুলের বেতন বাকি-এসব নিয়ে সুব্রতর চেয়ে বেশি চিন্তা আরতির। কিন্তু সুব্রতর উপর আরও দায়িত্ব না চাপিয়ে সে নিজে সমাধানের পথ ভাবে। সুব্রতর বন্ধুর স্ত্রী চাকরি করছে শুনে আরতিও আগ্রহী হয়। ইতিহাস বলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালে, নারীরা সাংসারিক প্রয়োজনেই বাইরে বেরোতে বাধ্য হয়, উপার্জন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু একবার উপার্জনক্ষম হয়ে ওঠার পর তদের চার দেওয়ালে বেঁধে ফেলা মুশকিল হয়। বরং নারীদের ভোটের আন্দোলন জোরদার হয় ক্রমশ। বাংলা তথা কলকাতার ক্ষেত্রে, সর্বপ্রথম কাজে বেরিয়েছিলেন ওপার বাংলা থেকে আসা ছিন্নমূল মেয়েরা। তাঁরাও বেরিয়েছিলেন সাংসারিক দারিদ্র নিরসন করতেই। কিন্তু পরবর্তীকালে নারী স্বাধীনতায় উপার্জনের উদ্দেশ্যে নারীর বাইরে বেরিয়ে পড়ার এই ঘটনার গুরুত্ব কম নয়। আরতির ক্ষেত্রেও ছিল একই পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা। কিন্তু ক্রমশ সে তার  অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে শেখে। শুধু তাই নয়, তার আত্মিক ও নৈতিক স্বাধীনতার যে যাত্রা, তারও সূত্রপাত হয়।

 

সুব্রতকে রাজি করানো সমস্যা হয় না, কারণ নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর খবর আরতি ছাড়া সবচেয়ে ভাল জানে সুব্রত নিজে। নিজেই সে পেপারে বিজ্ঞাপন দেখতে শুরু করে স্ত্রীর জন্য। খাড়া করে নারীর সমানাধিকার, চাকরির অধিকারের আধুনিক সব যুক্তি। বাবা-মাকে বোঝানোর দায়িত্বও সে নেয়। তার নারীবাদ প্রয়োজনের নারীবাদ।  কিন্তু সামাজিক শিক্ষাকে সে পুরোপুরি অস্বীকারই বা করে কী করে? স্ত্রীর ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া নিয়ে দ্বিধা, এমনকি প্রথমবার নিজের সইখানি করা নিয়ে তার ভীতিকে সে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখে। সই করতে গিয়ে আরতি জিজ্ঞাসা করে, মজুমদারে j লিখবে না z? অর্থাৎ শ্বশুরবাড়ির পদবী, বিয়ের পর পরিবর্তিত পদবী সে এখনও আত্তীকরণ করে উঠতে পারেনি৷ সই করার প্রয়োজন না পড়ায় মজুমদারে j না z, তা জানারও কখনও দরকার হয়নি। এসব সুব্রতকে আরও স্নেহশীল করে তোলে তার প্রতি।

 

কিন্তু সুব্রতর এই সপ্রশ্রয় দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটে। বস্তুত সুব্রত ছবিতে নানা পর্যায়ে নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। চাকরিতে স্ত্রীর উন্নতি শুরু হলে সে পুরুষালি হীনম্মন্যতা অতিক্রম করতে পারে না।  

 

ছবির ক্লাইম্যাকটিক দৃশ্য বর্তমান দর্শকের মতে দুটি। এক, যখন প্রথম মাইনে পাওয়ার পর আরতি অফিসের আয়নায় নিজের মুখখানি দেখে। সে মুখে আত্মবিশ্বাস ঝলকায়। এর ঠিক পরেই এডিথ তার ঠোঁট রাঙিয়ে দেবে লিপস্টিকে। এডিথ তার কপাল আর সিঁথি দেখিয়ে প্রশ্ন করবে, ওই দুই জায়গায় লাল ভাল, আর ঠোঁটে লাল খারাপ কেন? অর্থাৎ 'সিগনিফায়ার' আর 'সিগনিফায়েড' -এর সম্পর্ক যে সমাজপ্রসূত, তা তত্ত্বকথা না বলেও সত্যজিৎ বুঝিয়ে দেবেন।

 

দ্বিতীয় চূড়ান্ত মুহূর্তটি আসে তখন, যখন গর্ব ভরে আরতি সুব্রতকে বলে, সে কতটা দক্ষ কর্মী, কীভাবে সে প্রশংসিত হয় বসের দ্বারা। তার গলায় তখনও প্রত্যয় ঝরে পড়ে। সেই প্রত্যয় কিন্তু সুব্রতকে আড়ষ্ট করে। আরতি তার ইনফ্যান্টালাইজেশনের সীমা অতিক্রম করে দায়িত্বশীল কর্মী হয়ে উঠছে, এতে সে অসুরক্ষিত বোধ করে, কারণ স্বাবলম্বী নারী ভীতিপ্রদ। সে প্রশ্ন করে 'বাড়িতেও কি চিনতে পারব তোমায়?' আরতি মুখখানি ঝুঁকিয়ে গালের তিলখানি দেখিয়ে যখন বলে 'চিনতে পারছ না?', তখন ভালবাসার থেকেও আর্তি চোখে পড়ে বেশি৷

 

একই দৃশ্যের আরেকটি সংলাপ মনে পড়ে। আরতি যখন বলে, তার কর্মক্ষেত্রে প্রশংসিত হওয়ার কথা, কমিশন পাওয়ার কথা, সন্দিগ্ধ সুব্রত জিজ্ঞাসা করে, 'কী কর তুমি?' আরতি সবিস্তারে তার ক্যানভাসিং, রিপোর্ট তৈরি ইত্যাদির গল্প যতই করুক, সুব্রতর চোখ বলে দেয়, সে খুঁজছে অন্য কোনো উত্তর। প্রথমত আহত হচ্ছে তার আরতিকে 'আদুরে বউ মাত্র' ভাবার অভ্যাসটি। দ্বিতীয় সে সন্দিগ্ধ হচ্ছে, নারীর কর্মক্ষেত্রে উন্নতি কি কর্মক্ষমতার জন্যই? নাকি তার যৌন আবেদনের জন্য? আরতির বস্ মিঃ মুখার্জি সম্পর্কে সে যখন বলে, 'একদিন দেখে আসতে হচ্ছে,' তখন তার যৌন ঈর্ষা প্রকাশ হয়ে পড়ে।

 

সুব্রত আরতিকে চাকরি ছাড়তে বলে। অথচ আরতি তখন তার স্বাধীনতা উপভোগ করতে শিখেছে। এক রকম জোর করেই রেজিগনেশন লেটার গুঁজে দেয় সে আরতির ব্যাগে। কিন্তু মোক্ষম দিনটিতে সুব্রত নিজেই চাকরি হারায়। তার ব্যাংক সর্বস্বান্ত হয়। আরতির আর চাকরি ছাড়া হয় না। রোল রিভার্সাল সম্পূর্ণ হয়।

 

শাশুড়ি আরতিকে মাছের মুড়োটি বেড়ে দেন, কারণ তার চাকরির অর্থ ছাড়া তখন সংসার অচল। সুব্রতকে কাজের মেয়ের মাইনের দুটি টাকা নিজের ব্যাগ থেকে বের করে দিতে বলে ব্যস্ত আরতি। সুব্রত নত মস্তকে আজ্ঞা পালন করতে গিয়ে যে হীনম্মন্যতায় ভোগে, তা আরতি কখনও ভোগ করেনি স্বামীর অর্থ খরচ করতে গিয়ে। পুরুষের উপার্জনক্ষম হওয়ার যে লিঙ্গ নির্ধারিত সামাজিক বাধ্যবাধকতা, তাকেও পরোক্ষে সমালোচনা করতে ভোলেন না সত্যজিৎ। যে পিন্টু মায়ের অফিসে যাওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ, সে কিন্তু বাবাকে অফিসে না যেতে দেখে খুশি হয় না৷ বরং জিজ্ঞাসা করে, বাবার এতদিন ছুটি কেন? আরতি নিজেও তার বান্ধবীর বরকে বলে,  সুব্রতর বিরাট ব্যবসা, এ তার নেহাতই শখের চাকরি। আরতি জানে, সে নিজে যতই তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উপভোগ করুক বা সংসারের প্রয়োজনে যতই উপার্জন করুক, সে কথা প্রকাশ্যে বলা 'সম্মানজনক' নয়। সামাজিক সমীকরণ সুব্রতকেই প্রধান উপার্জনকারী হিসেবে দেখতে চায়। তেমনটা না হলে সুব্রতর 'অপমান'।

 

সত্যজিতের চরিত্রগুলি কেউই স্টিরিওটাইপ হয়ে ওঠে না। লক্ষ্য করি, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাহিনীর শ্বশুর আরও অনেক কঠোর। ছবিতে প্রবল পেট্রিয়ার্ক পিতা তথা শ্বশুর, যিনি কখনই গৃহবধূর চাকরি মেনে নিতে পারেন না, তাঁরও আছে নিজস্ব অসহায়তা। 'গুরুদক্ষিণা' শব্দটি ঘিরে অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাইটির আছে সামন্ততান্ত্রিক রোমান্টিসিজম। কোনো প্রাক্তন ছাত্র তার মর্যাদা দেয়, কোথাও তিনি অপমানিত হন।  একই কথা প্রযোজ্য শাশুড়ির জন্য। লেখকের শাশুড়ি চরিত্র দুর্মুখ। ছবিতে তিনি অভিমানী, সংস্কারাচ্ছন্ন, কিন্তু তাঁর নিজেরও পিতৃতন্ত্রের শিকার হওয়ার দিকটি স্পষ্টতর। তিনি নিজের জন্য ভাবতেই শেখেননি। পুত্রবধূকে বলেন, 'স্বামী' খুশি থাকলেই তিনি খুশি৷

 

একই ভাবে, আরতির অফিসের বস মিস্টার মুখার্জি (হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়) এমনিতে সহানুভূতিশীল, কিন্তু প্রবল প্রাদেশিক। যে সুব্রত তাঁকে আদতে ঈর্ষা করে, তাকেও তিনি কাছে টেনে নেন, কারণ পুর্ববঙ্গে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা একই অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এডিথ তাঁর চক্ষুশূল। মধ্যবিত্ত বাঙালির যে চোখটি ভদ্র, লক্ষ্মীমন্ত গার্হস্থ্য বাঙালি বধূ বনাম স্কার্ট, লিপস্টিক, হিল তোলা জুতো পরা পশ্চিমী ঢঙের অলক্ষ্মী মেয়েদের দ্বৈরথ গড়ে তোলে, সেই চোখটি এই ছবিতে যথার্থ ভাবে পেয়েছেন মি; মুখার্জি। এডিথকে তিনি সহ্য করতে পারেন না তার সাজ-পোষাক, চলন-বলনের জন্য৷ তুলনায় নম্র, ভদ্র বাঙালি বধূ আরতি তাঁর পছন্দের কর্মচারী। মালিকপক্ষের সঙ্গে প্রাপ্য নিয়ে ফয়সলা করতে হলেও কর্মচারীদের প্রতিনিধি হিসেবে এডিথ নয়, আসুক আরতি- এমনটা তিনি স্পষ্ট করে চান। কারণ মৃদুভাষী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা সহজ। তাতে পুরুষের চোখের ও কানের আরাম আহত হয় না। তিনি নিজের ফার্মে আরতির উন্নতি চান। কিন্তু সামান্যতম অজুহাত দেখিয়ে এডিথকে চান বরখাস্ত করতে৷ মালিক তথা পুরুষের অহং ভুলতে পারে না, এই এডিথই মেয়ে তথা অধস্তন হয়ে কমিশনের জন্য মুখে মুখে তর্ক করেছিল। তর্ক অবশ্য সে করেছিল সকলের হয়ে, সকলের জন্য।  সব সেলসগার্লদের প্রতিনিধি হিসেবে। পশ্চিমি বিশ্বে ষাটের দশকে কর্মক্ষেত্রে নানা আলোড়ন হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সমান মাইনে, সমান সম্মানের দাবি প্রখর হচ্ছে। এডিথ সেই সমকালকেই নিয়ে আসে কলকাতায়, নিটিং মেশিনের সেলসগার্লদের মধ্যে। সেলসগার্লদের হাসি-ঠাট্টা, টিফিন ভাগ করে খাওয়ার দৃশ্যটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাদের ভগিনিত্বে। সেই কামরাদারি প্রকাশিত হয় ছবিতে পরবর্তীকালে অধিকারের লড়াইতেও।

 

এডিথকে শরীর খারাপের জন্য অনুপস্থিতির সামান্য অজুহাতে বরখাস্ত করতে পিছপা হন না মি: মুখার্জি। শরীর খারাপ নয়, আসলে সে 'মজা করছিল' -এমনটা বলে তিনি এডিথের চরিত্রের দিকে কুরুচিকর মন্তব্য ছুড়ে দেন অনায়াসে। দুর্মুখ, সপ্রতিভ, সাজগোজ করা মেয়ে তো দুশ্চরিত্র হবেই! আজকের ভাষায় একে স্লাটশেমিং বলা হয়, যার বিরুদ্ধে শহরে শহরে হয় 'স্লাট ওয়াক'। সত্যজিতের আরতি অথচ সেসব ভবিষ্যতের থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে সটান প্রতিবাদ করে এডিথের অপমানের। শুধু তাই নয়, আরতি তার বসকে ক্ষমা চাইতে বলে এডিথের কাছে। তিনি স্বভাবতই রাজি হন না। আরতি অনেক দিন ধরে ব্যাগে রাখা রেজিগনেশন লেটারটি ধরিয়ে দেয় তাঁকে৷

 

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের চেয়ে সত্যজিৎ আলাদা হয়ে যান মূল পুরুষটির চরিত্রের রূপান্তর আঁকার ক্ষেত্রেও, বিশেষত শেষে এসে পৌঁছে। লেখকের আরতি চাকরি ছাড়লে বাড়িতে এসে আবারও সুব্রত তথা শ্বশুর শাশুড়ির রোষের মুখোমুখি হয়। সকলেই তার হঠকারিতাকে দোষে। অর্থাৎ, আরতির এজেন্সি, তার স্বকীয়তা ও স্বেচ্ছাকে মর্যাদা দিতে তার পরিবার শেখে না। প্রথমে যে ছিল তাদের বশংবদ বধূ,পরবর্তীতে সে বশংবদ চাকুরিরতা হয়েই থাকবে, এমনই ছিল আশা।

 

সত্যজিতের সুব্রত কম 'অ্যাগ্রেসিভ' নরেন্দ্রনাথের সুব্রতর চেয়ে। পুরুষ ও পৌরুষ এ ছবিতে একমাত্রিক নয়। তার নানা পরত ও তা নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। বসের সামনে পদত্যাগপত্রটি দিয়ে কোনো রকমে বিল্ডিংয়ের নিচে পৌঁছালেই সুব্রতর সঙ্গে আরতির দেখা হয়ে যায়। দুজনেই বেকার। সে কি ভুল করেছে? হঠকারিতা হল কি? সুব্রত স্তম্ভিত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরতির সততা ও সাহসিকতাকে বাহবা দিতে সক্ষম হয় সে। যে লোকটি  স্ত্রীর সামান্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতাতেই প্রমাদ গুণছিল, সে শেষপর্যন্ত স্ত্রীর নীতিগত ও আদর্শগত স্বাধীনতার প্রশংসা করতে পারে। সে বলে,

 

-তুমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছ, সেটা কি ভুল?

তুমি যা করেছ, আমি তা করতে পারতাম না। আমার সাহসে কুলোত না। রোজগারের তাগিদে আমরা ভীতু হয়ে গেছি, আরতি। কিন্তু তুমি তো হওনি। এটা কি কম হলো?

 

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়ে তারা ভেঙে পড়ে না, শুধু তাদের মাঝের দেওয়াল ভেঙে পড়ে।  আরতি যখন সুব্রতকে জিজ্ঞাসা করে,

 

-এত বড় শহর, এত রকম চাকরি। দুজনের একজনও কি পাব না একটা?

 

তখন সুব্রত বলে-

 

-চেষ্টা তো করি। আমার বিশ্বাস দুজনই পাব।

 

'মহানগর' নামটি হয়ত খানিক আয়রনিকাল। বিরাট শহর, অথচ তার চলটা তুললে আরতি বা এডিথদের দারিদ্রের বাস্তবতা, যা ততটাও মহান নয়। সেই শহরের বিশালতায় দুই নর-নারী মিশে যায়, ডুবে যায়, ভেসে ওঠার জন্য। ছবিটি গভীর আশাবাদে শেষ হয়।

 

এডিথও হয়ত ফেরে হতদরিদ্র অ্যাংলো পাড়ায়, চাকুরিবিহীন। সুব্রত আর আরতির হাতে হাত ধরা দৃশ্যত দেখা যায়। আরতি আর এডিথ- এই শ্রমিক নারীদ্বয়ের হাতে হাত ধরা বহির্চক্ষুতে দেখা যায় না। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি তা অনুমান করতে পারে। আরতির প্রতিবাদের আশ্বাসটুকু নিয়ে এডিথ বাসায় ফিরেছিল সেদিন। সত্যজিৎ, আপনি কি জানেন কি অগ্নিময় অথচ মায়া-ভরা 'সিস্টারহুডের' বার্তা আপনি রেখে গেছেন ভবিষ্যতের নারীবাদীদের জন্য?