সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী

ইংরেজির ১৯৯১ সাল। সত্যজিৎ রায় , Academy of Motion Picture Arts and Sciences (64th) - এ Academy Honorary Award পেলেন। আমি তখন এমন এক শহরে বাস করি যেখানে শুধুই হিন্দি তে কথা হয়, লোকে শুধুই 'হিন্দি সিনেমা' দেখে। বাংলায় শুধু কথাটুকুই বলতে পারি আমি, লিখতে পড়তে পারি না। আর বাংলা সিনেমা দেখার তো কোনোই উপায় নেই। এই সময় এক দিন সন্ধ্যাবেলায়, বাড়িতে বাবা জানালেন, আজ থেকে আগামী ৭ দিন, রোজ রাত এগারোটা থেকে আমরা, পরিবারের সকলে, সিনেমা দেখবো। কোন এক চিত্র পরিচালক, যার নাম নাকি সত্যজিৎ রায়, তিনি বিরাট কোনো 'অস্কার' পেয়েছেন, এবং তাঁর ৭ টি সিনেমা নাকি আগামী ৭ দিন টিভি তে সারা রাত ধরে দেখাবে। আমি ছোট থেকেই সিনেমা দেখার পোকা। তাও আবার রাত জেগে প্রতিদিন সিনেমা দেখবো ! ভাবাই যায় না।!!আমার বয়স তখন অপু আর দুর্গার মাঝের একটা বয়েস। প্রথম দিনের প্রথম সিনেমা, পথের পাঁচালী। সেই রাতে, সেই অন্ধকারে, ছোট্ট অপু আর দুরন্ত দুর্গার গ্রাম বাংলার মাঠে, জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া, বৃষ্টি ভেজা দুপুরগুলোর গ্রাম বাংলার অন্যমনস্ক নিবিড়তা, সেই রাতের গভীর অন্ধকারে আমার মনের গভীরতম অনুভূতিকে স্পর্শ করেছিল। আর একটা কথা মনে আছে, সেই রাত জুড়ে আমি অপুর জন্য, দুর্গার জন্য কেঁদেছিলাম। পর পর সব কটা সিনেমাই দেখি, সে এক অন্য অভিজ্ঞতা, সেই নিয়ে আলাদা করে লেখা যাবে কখনো, কিন্তু অপু আর দুর্গার গভীর দুই চোখে সত্যজিৎ রায় যেভাবে গ্রাম বাংলা কে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যে ভাবে মেঠো আল পথ, পুকুর, নিবিড় ছায়াময় বাঁশের জঙ্গলে আলোছায়া মাখা করুণ সুর তুলেছিলেন, সে আমার ছোট শিশু মন কে জীবনের এক অন্য সত্য বুঝতে শিখিয়েছিল। এখানেই সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী চিরকালীন সার্থকতায় বেঁচে রয়ে গেলো। আমাকে কেউ বলে দেয়নি কোন সিনেমা ভালো বা কোন সিনেমা সত্যিকারের 'আর্ট ফিল্ম' , সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখে অনুভব করেছিলাম, জীবনের মুখমুখী তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন, প্রায় অপুর বয়সী একটি বালিকাকে। বড় হয়ে তাঁরই নামে স্থাপিত 'ফিল্ম ইনস্টিটিউট' পড়তে এসে,  বয়েস হয়ে যাওয়ার পরে, ইউরোপিয়ান ও পৃথিবীর বহু শ্রেষ্ঠ সিনেমা দেখার পরেও যখন আবার অডিটোরিয়ামে পথের পাঁচালী দেখতে বসেছি, সেইদিন অবাক হয়ে সেই একই অনুভূতির মাঝে পড়ে গেছি। আবার দুচোখ ভরে গেছে কান্নায়, বেশ লজ্জা পেয়েছি, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দেখি আমার সহপাঠীও তো সেই একই অভিজ্ঞতার শিকার !!

 

তবে কি এমন সিনেমা সত্যজিৎ রায় বাঙালিকে আর এই পৃথিবীর সমস্ত সিনেমা প্রেমিকদের উপহার দিলেন, যে সিনেমার ইতিহাসে '' অপু ট্রিলজি" ক্লাসিক হয়ে , চিরকালীন হয়ে রয়ে গেলো ?

যে সিনেমা তার 'ভাষা' ও অভিনয়ের গুনে মানুষের হৃদয় কে স্পর্শ করতে পারে, তাই চিরকালীন হয়ে থেকে যায়। তাই সিনেমার জগতে ইতিহাস তৈরি করে। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী তেমনই সিনেমা যা মানব হৃদয়ের অনুভূতির কোটরে গভীর ভাবে নাড়া দিয়ে যায়, চিরকালের মতো বসত স্থাপন করে। রবার্ট ব্রেসোঁ বলেছিলেন,

 

I'd rather people feel a film before understanding it. ..feelings arise before intellect.

 

ঠিক এই কথাটাই সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত পথের পাঁচালীর ক্ষেত্রে খাটে ।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী বাংলা ও পৃথিবীর সাহিত্যে অমূল্য, তাঁর বর্ণনা তাঁর চরিত্র চিত্রণ -এর তুলনা সাহিত্য জগতে নগণ্য এবং সেই কারণেই সত্যজিৎ রায়ের সামনে পথের পাঁচালী নির্মাণ ছিল আরো বেশি কঠিন। কারণ চলচিত্রের ইতিহাসে দেখা গেছে, সফল বা মহৎ সাহিত্য বেশির ভাগ সময়েই সিনেমা হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে।

তাই সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী সাফল্যের মূল কারণ বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী না, তাঁর সিনেমার 'ভাষা' কে গভীর ভাবে জানা ও তাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা।

সিনেমার সূচনায় দেখি, নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে হরিহর রায়ের সংসারে থাকেন তাঁর স্ত্রী সর্বজয়া , তার ছোট্ট মেয়ে দুর্গা আর দুর্গার বুড়ো পিসি। ভাঙা চোরা দালানের মধ্যেও বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়, এক কালে প্রতিপত্তি ছিল এ বাড়ির। ছোট দুর্গা বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসে কুড়িয়ে, লুকিয়ে, হরিহরের স্ত্রী সর্বজয়ার কথা থেকে বুঝতে পারি, সে বাগানও একদিন তাদের ছিল, ধারের নামে সেজো খুড়ি লিখিয়ে নিয়েছে। অভাব অনটনের জীবন, সর্বজয়ার ভালো লাগে না ,আর ভালো লাগে না, হরিহরের এই দূর সম্পর্কের দিদি ইন্দির ঠাকুরন কে। সর্বজয়ার কথা সহ্য না করতে পেরে যে প্রায় দিনই ভিটে ছাড়ে। আর এর মধ্যেই একদিন অপুর জন্ম হয়। আমরা দেখি অপুর জন্ম, বড়ো হয়ে ওঠা , পাঠশালা যাওয়া, পন্ডিত মশাইয়ের চাল বিক্রি করতে করতে পড়ানো, গ্রামের চন্দ্রপুলি ওয়ালাকে দেখে দুর্গার লোভ , দুর্গার নানা খোঁজে গ্রাম জঙ্গল চোষে বেড়ানো। এই সব ছোট ছোট নিখুঁত scene- এর বুননে পথের পাঁচালী আঁকা হয়। আর যা পুরো সিনেমাটিকে ধরে রেখেছে তা হলো নিশ্চিন্দিপুরের প্রকৃতি। এই সিনেমায় প্রকৃতি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি চরিত্র হয়ে প্রকাশিত হয়, যার হাতেই এই পথের পাঁচালীর দিক পরিবর্তনের সমস্ত শক্তি। সত্যজিৎ রায় বিভূতিভূষণের সেই পথের পাঁচালী কে ভোলেননি কখনোই।তাঁর একের পর এক সিন্ জুড়ে প্রকৃতির সেই দুনির্বার ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

 আর জীবনের চরম সত্য কে খুব কঠিন অনুভবে অথচ খুব কাব্যিক ভাবে প্রকাশ করেন সত্যজিৎ রায়। সেই সত্য হলো মৃত্যু। ।

 

 

সিনেমার প্রথম থেকে গান শোনা যায় ..., ' হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে। "... ভাঙা দালানে চাঁদনী রাতে যখন আলো অন্ধকারে একা গলায় গানটি গেয়ে ওঠে ইন্দির ঠাকুরণ, বোঝা যায়, মৃত্যু ঠিক জীবনের ই কাছে বাস করে। সেই অপার্থিবতায়, সেই আকুতিতে অন্ধকারে মানুষ পরের পারানির ডাক শুনতে পায় ... ইন্দির ঠাকুরণের মুখের অজস্র ভাঁজে যেন বার বার জীবন মৃত্যু মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিস্ময় খেলা করে যায়।মৃত্যুর আগে দালানে এসে ঘটিতে করে জল খায় ইন্দির আর ঘটির অবশিষ্ট জল টুকু চারা গাছটিকে ঢেলে দেয়। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে, জীবনের প্রতি তার যে ভালোবাসা, মায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে ... সত্যজিৎ রায়ের সেই ডিটেলিং এর ক্ষমতা চমকে  দিয়ে যায়।

   আর দুর্গা যেন জানে তার মৃত্যুর কথা। সারা সিনেমা জুড়ে সে বলে যায়, 'তার কোনো দিন বিয়ে হবে না', তার সখীর বিয়ের দিন তার দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল... দারিদ্র আর নিরানন্দ যেন তাকে গভীর ভাবে বুঝতে শিখিয়েছে যে জীবন তার জন্যে নয়। পরিচালক সত্যজিৎ রায় সেই বেদনা বয়ে বেড়ান তাঁর সিনেমায়, দুর্গার এই চরিত্র চিত্রণে। ইন্দির ঠাকুরণের থেকে দুর্গার মৃত্যুর যে সময় ( screen time) এই সিনেমায় তা খুব অল্প। মৃত্যু যে এ বাসায় ঢোকে আর ছাড়তেই চায় না। রেলগাড়ি দেখার ইচ্ছে যে কিশোরীর, বিয়ের আশায় যে ছোট্ট একটা চারা গাছ কে পুজো করে, তার তো অদম্য কামনা বেঁচে থাকার ! চরম প্রাণ শক্তি যে কিশোরীর, যার উদ্দামতার ছন্দ পুরো সিনেমা কে ধরে রেখে দেয়, সে যেন জানে আনন্দের ভোগ তার জীবনে নেই। এই যে তথাকথিত গ্রামবাংলার এক ছোট্ট গ্রামের, ছোট্ট একটি পরিবারের বেঁচে থাকার গল্পের আড়ালে সত্যজিৎ রায় এক অজানা ও গভীর প্রশ্ন করে যান, এই যে মৃত্যু কে মানুষ তার গভীরে অনূভব করে... যা এক অনন্ত চরাচর জোড়া চিরকালীন ভয় ও বিস্ময়। ছোট ছোট detailing দিয়ে পরিচালক সত্যজিৎ অচিরেই এক গভীর দার্শনিক প্রশ্ন সামনে দাঁড় করিয়ে দেন ।

চরিত্র চিত্রণের অশেষ ক্ষমতা সত্যজিৎ রায়ের। এই বৃদ্ধা ইন্দিরঠাকুরণের রাগ অভিমান, তার ছোট ছোট জিনিসের প্রতি ভালোবাসা তাকে বাংলা সিনেমা জগতে এক আশ্চর্য চরিত্র করে তুলেছে। চুনিবালা দেবীর বয়সে তাকে নিয়ে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে কাজ করে, ইন্দির ঠাকুরন কে গড়ে তোলেন তিনি। তাঁর নিজের স্মৃতি কথায় সত্যজিৎ রায় সে অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। কিভাবে তার বয়সের একজন অভিনেত্রী কে অভিনয় করাতে গিয়ে তিনি প্রতিদিন বিবেকের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন, রোদ্দুরে এই বৃদ্ধা অভিনেত্রীকে দাঁড় করিয়ে কাজ করানো তার কাছে কতটা বেদনাদায়ক ছিল সে সব আমরা পড়ি।

     সর্বজয়া বা হরিহর চরিত্র নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, বহু মানুষ লিখেছেনও তার কথা। আমার কাছে যে বিষয়টি সবচেয়ে আকর্ষণীয় তা হলো হরিহর, সর্বজয়া, অপু বা দুর্গার সংলাপ বলার ধরন। কোথাও এক ফোঁটা ভুল হয় না যেন। হরিহরের কথা বলার সেই 'tone', তার বসার তাকানোর ধরন !! সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী দেখা যেন তখন একলা বসে একটা সিনেমার ক্লাস করা!!

 

সিনেমার শট নেওয়ার আগে, ক্যামেরা চালু হওয়ার প্রথমেই একজন পরিচালক যে একমাত্র শব্দটি উচ্চারণ করেন তা হলো 'অ্যাকশন'। একজন চরিত্র যদি নাও নড়ে তাও 'অ্যাকশন' তার থামে না । সেই নীরব স্থির 'অ্যাকশন'ও একটি শট থেকে আর একটি শটে narrative কে নিয়ে যায়।

Robert Bresson লেখেন,

 

Let it be the intimate union of the images that charges them with emotion.

 

সত্যজিৎ রায়ের shot যে আলো ছায়া দিয়ে ছবির মায়া তৈরী করে তা কেবলি সৌন্দর্য তৈরি করে না। তা অনুভূতির গভীরে নিয়ে যায়, ইমোশন কে ধাক্কা দেয়,  শুধু মাত্র মুভমেন্ট ও অ্যাকশন (with sound) দিয়ে shot এর পর shot জুড়ে গল্প বলেন তিনি। দুর্গা মারা যাওয়ার পর, অপু এক বাদলা দিনে বাড়ি থেকে বেরোয়, কিন্তু উঠোনে নেমেই আকাশের দিকে সে তাকায়, আজ সে অল্প মেঘকেও ভয় পায়। ফিরে আসে ঘরে, ছাতা টা নিয়ে সে বাহির হয়। এই যে অপু চরিত্রটি, যে দিদির সঙ্গে জলে ভিজে 'লেবু পাতায় করমচা /এই বৃষ্টি ধরে যা' শুনছিল, সে আজ আর ছেলেমানুষী ছড়ায় বিশ্বাস করে জীবন কাটায় না। জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে বড় করে তুলেছে যেন এই কদিনেই।  একটি shot দিয়ে, নীরবে সত্যজিৎ রায় তা বুঝিয়ে দেন, অ্যাকশন দিয়ে , তিনি তার সিনেমার emotion কে প্রকাশ করেন ।

 

অপু চরিত্র হলো সেই "অ্যাকশন"এর স্পষ্ট উদাহরণ, যেখানে অজস্র dialogue ছাড়াই অপুর গল্প বলে যান তিনি। পুরো সিনেমা ধরে খুব কম dialogue আছে অপুর। এবং সেই কম কথাই অপু চরিত্র কে গড়ে তোলে। সে যে খুব গভীর ভাবে অনুভব করে সব কিছু, তার ডাগর চোখ মেলে সব কিছু দেখে। পাঠশালার পন্ডিত মশাইয়ের আচরণ, রাতের যাত্রা পালা আর তার দিদি দুর্গার ব্যথাতুর চোখ কিছুই এড়িয়ে যায় না তার শিশু চোখে। আর  তার শরীরে আছে এক অদ্ভুত ছন্দ, ট্রেন দেখতে যাওয়ার জন্য তার যে দৌড় !

 

দুটো 'অ্যাকশন' আমার গভীর ভাবে মনে পড়ে। প্রথমটি হলো অপুর যাত্রা দেখার উত্তেজনা। রাতের বেলা যাত্রা পালা চলছে, সামনের সারি তে অপু, তখন তলোয়ার নিয়ে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়েছে, আর সেই যাত্রার উত্তেজনায় শিশু অপু চেপে ধরেছে সামনের বাঁশের ব্যারিকেড টি। আর একটা হলো, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলছে অপু, মা খাওয়াচ্ছে,  হঠাৎ সর্বজয়া জিজ্ঞেস করে -তুই ছেলে মানুষ বলে তোকে কেউ ঠাট্টা করে না?' কিছুক্ষন আগেই দেখিছি তার বয়সী ছেলেরা তাকে এলেবেলে বলে খেপাচ্ছে, এবং তার পর সর্বজয়ার এই প্রশ্ন! রাগে অপু একটি টুকরো আর মুখে নেয় না। সর্বজয়া ভাবে, এই সাদা মাটা খাওয়ার তার মুখে রুচে না, সে সমস্ত খাওয়ার ফেলে দেয়, এবং তার দারিদ্র কে নিয়ে হতাশা তীব্র ভাবে তার কথায় ফুটে উঠে। অথচ অপুর রাগের কারণই তা না। এই যে দুটি আলাদা মানুষের দুটি জগৎ, যেখান থেকে তাদের প্রতিক্রিয়া একই scene এ আলাদা দুটি 'অ্যাকশন' দিয়ে ফুটিয়ে তোলার অসামান্য ক্ষমতা !!

প্রকৃতি রহস্যময়। যে আলো ছায়া ক্যামেরার লেন্স দিয়ে বন্দী করেন তিনি, তার মাঝে জেগে উঠে পিচ্ছিল মেঠো পথ, বন্দী করেন এক নিরবিচ্ছন্ন সময় জোড়া এক রহস্য নিবিড় প্রকৃতি কে, যা সকল চরিত্র ছাপিয়ে বেশির ভাগ ফ্রেম জুড়ে থাকে। অথচ সে নীরব। বৃষ্টির শব্দে, এক অজানা গুঞ্জনে যে sound scape , তা এক অসীম ব্যাপ্তি নির্মাণ করে। যে ফ্রেমে সে দৃশ্যমান থাকে না, সেখানে অফ স্ক্রিন সাউন্ড, প্রকৃতির বিরাট ব্যাপ্তি ফুটিয়ে তোলে। যে ভাবে প্রকৃতি তার তীব্র রূপ নিয়ে জেগে থাকে, দিগন্ত বিস্তৃত কাশ জঙ্গলের মাঝে, অপুর ট্রেন দেখার ফাঁকে, যেখানে তার অনিশ্চিত পথের নিশান যেন আঁকা হয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরে পড়ে, যে বৃষ্টি যেন আর কিছুতেই ধরে না, দুর্গা কে কাছে না টেনে নেওয়া পর্যন্ত। সিনেমা যখন শুরু হয়, তখন ও ছোট্ট দুর্গা এক বন পথ পেরিয়ে চলেছে। আর যে রাতে দুর্গার মৃত্যু ঘটে, দরজা, জানালা যেন ভেঙে পড়তে চায়, সে বিরাট ঝড়ে ঘর দুয়ার উঠোন তোলপাড় করে প্রকৃতি যেন দাঁড়িয়ে আছে ভাঙনের মুখে। দুর্গার মৃত্যুর রাতের scene খুব স্পষ্ট ভাবে, সেই বন্ধ ঘরের মাঝেই প্রকৃতির সেই ভয়াবহতা কে অফ স্ক্রিন সাউন্ড আর আর মুভমেন্ট অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলে। আর যখন সাউন্ড এর কথা আসে তখনই আসে সেই অপূর্ব আবহ সংগীতের কথা, পন্ডিত রবিশঙ্করের যন্ত্রাণুষঙ্গের কথা। সারা সিনেমা জুড়ে সেই মায়া !!! দুর্গার মৃত্যুর পর হরিহরের সর্বজয়া কে করা সেই প্রশ্ন যখন আর শোনা যায় না, বিরাট ভাবে বেজে ওঠে সংগীত। অনেকেই সংগীত- এর ব্যবহার কে সিনেমায় পছন্দ করেন না, কিন্তু আমি দেখেছি মাস্টারদের হাতে পড়ে তারা যেন জীবনকেই আরও গভীর ভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। তা সে আন্দ্রেই তারকোভস্কির' 'মিরর' এ  বাখ এর ব্যবহার হোক বা সত্যজিৎ রায়ের সংগীত ব্যবহার হোক। যে সিনেমা ও সংগীত দুটোই গভীর ভাবে জানে, এই দুটি 'আর্ট ফর্ম' কে আত্মস্থ করেছে, সেই পারে। তা যেন তথাকথিত চোখে দেখা জীবন এর মাত্রা ছাড়িয়ে জীবনের রহস্যময়তার সামনে মানুষ কে দাঁড় করিয়ে দেয়।

আর একটা বিষয় যা উল্লেখ করেতে চাই, তা হলো gaze, এবং point of view shots। দূর্গা ও অপুর gaze বা দৃষ্টি দিয়ে আমরা এই গ্রাম টাকে দেখি, তাদের অনুভূতির খবর পাই, এই দুটি শিশুর আনন্দ ও দুঃখের কাহিনীও চিনতে পারি। ইন্দির ঠাকুরন মৃত্যুর আগে যখন শেষবারের মতো ভিটেয় আসে তখন সর্বজয়ার ব্যবহার, তার ইন্দির ঠাকুরুনের দিকে তাকিয়ে দেখা ও না দেখার যে কাহিনী চলে তার মধ্যে এক অদ্ভুত শীতলতা ফুটিয়ে তোলেন সত্যজিৎ রায়। এমনভাবেই দুর্গার চোখে এক অসম্ভব রাগ, তার দৃষ্টিতে তার দেখায় প্রকাশ পায়। সে চারিদিকে মানুষের পাওয়াগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে, আর কিছুতেই যেন নিজের না পাওয়াগুলো মেনে নিতে পারে না। অন্যদিকে চিরবিস্ময় অপুর চোখে। যা কিছু সে তাকিয়ে দেখে, তার যে দৃষ্টি বা gaze , তার মধ্যে যেন এক অদ্ভুত কৌতুক আর মায়া। সেই দৃষ্টি পাল্টে যায়, দুর্গার মৃত্যুর পর। এ ভাবেই ''না বলা ভাষার যে জাল'' সত্যজিৎ রায় গড়ে তোলেন তা সিনেমার দর্শককে আরো গভীর ভাবে দেখতে শেখায়, ভাবতে সাহায্য করে।

মানুষের প্রতি যে গভীর মমত্ববোধ বিভূতিভূষণ তার লেখনিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা সত্যজিৎ রায় কোথাও ছেড়ে যান না। কাহিনী বলার ধাপের বদল ঘটে, কিন্তু কোথাও সেই মন হারিয়ে যায় না।

আর নীরবতা এক অপূর্ব আবহ সংগীতের মধ্যে দিয়ে যখন বয়ে নিয়ে যায় পথের পাঁচালীকে, দাঁড় করিয়ে দেয় গভীর সব প্রশ্নের মুখোমুখি, তখন পথের পাঁচালী কাব্যের মাত্রা পায়। সব সিনেমা কাব্যের মাত্রা পায় না। কিছু কিছু সিনেমা পায়। যা আমাদের তথাকথিত জীবনের চোখে দেখা জীবন কে ছাড়িয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত নিগূঢ় সত্য গুলির সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। পথের পাঁচালীকে নিয়ে বলা কথা এতো সহজে শেষ হয় না। আরো টেকনিক্যালি কথা বলা যায়, তার ফ্রেম, সিনেমাটোগ্রাফি, তার এডিট, সেসব আরো অন্য কোথাও বলা যাবে। হয়তো কোনো সিনেমা পাগল কেউ, যে সিনেমা শিখতে চায়, তার সঙ্গে কথা বলায়, বা কোনো ক্লাসে, কিন্তু এ লেখা তো তার কোনোটাই নয়, এ এক স্মৃতি রোমন্থন, কোনো এক পথের যাত্রার কালে উঠে আসা । পথের পাঁচালী আমাকে মানুষের কাছে নিয়ে গেছে, জীবনের গভীর সেই সত্যের দিকে হাতছনি দিয়ে দেখিয়েছে, যার আভাস বা অনুভূতি ছোট্ট বেলার সেই রাতের অন্ধকারে ফুটে উঠেছিল, অথচ যে সিনেমা প্রতিবার নতুন হয়ে ওঠে। আজ ও, প্রতিবারের দেখায়।