ষাট এবং সত্তরের সত্যজিৎ : আঙ্গিকের রাজনীতি

‘চূড়ান্ত ক্ষোভ আর যন্ত্রণার কাব্যে যে কলকাতা ফেটে পড়ছে, তার কোনো স্থান সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে নেই’।

চিদানন্দ দাশগুপ্ত, “রে অ্যান্ড টেগোর”, সাইট অ্যান্ড সাউন্ড উইন্টার ইস্যু, ১৯৬৬

‘কিন্তু ফর্মের কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আমরা করিনি। আঙ্গিকের যে নিজের ইতিহাস থাকে, তার বিকাশের সামাজিক সূত্র থাকে, অতএব রাজনৈতিক সূত্র থাকে – এই দিকটায় তখন নজর পড়েনি’।

মৈনাক বিশ্বাস, “কলকাতা ৭১, পদাতিক ও তৎকালীন চিত্রসমাজ”, চিত্রভাষ মৃণাল সেন বিশেষ সংখ্যা, ২০১৭

 

রাজনৈতিক ছবি এবং সত্যজিৎ রায় – এই দুইকে পাশাপাশি রেখে পড়তে সময়ে সময়ে আমাদের বেগ পেতে হয় – কারণ অন্তত প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০)–র আগে পর্যন্ত সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সক্রিয়ভাবে সমকালীন রাজনৈতিক বিষয় উঠে আসেনি। সত্যজিতের সময়কালে তাঁর ছবি নিয়ে একাধিক আলোচকের লেখায় সামান্য চোখ বুলালেই টের পাওয়া যায়, ষাটের দশকের সূচনা থেকে ক্রমশঃ অস্থির হতে থাকা পারিপার্শ্বের সঙ্গে তাঁরা অনেকেই সত্যজিতের ছবির সামঞ্জস্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ১৯৫৯’র জুলাইতে ঘটে যাওয়া খাদ্য আন্দোলনের সেই সহিংস রূপের ছবি – কলকাতার প্রকাশ্য রাস্তায় বাস-ট্রাম পুড়ছে – আর সত্যজিতের সেই বছরে, মাত্র একমাস আগে মুক্তি পাওয়া অপুর সংসার (১৯৫৯), পরের বছরের ছবি দেবী (১৯৬০) তে স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন দর্শক-সমালোচকেরা সমকালের দ্রোহের সাথে কোনো সংযোগসুত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ক্রমশঃ সত্যজিৎ রায়ের ছবি তাঁদের কাছে হয়ে উঠছিল মঞ্চের ওপারে রাখা কোনো পূজ্যবস্তুর মতো – যাকে ফুলবেলপাতা দিয়ে সম্মান করা যায় ঠিকই – কিন্তু যা আখেরে সমকালের সঙ্গে জুড়ে থাকে না, যাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটার সময় আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ষাটের দশকের সূচনায় কলকাতা যখন জ্বলছে, আর সত্যজিৎ তখন হয় ঘুরে বেড়াচ্ছেন অপুর স্বপ্নের জগতে, অথবা উনিশ শতকের কলকাতায় (রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে একাধিক ছবি পরপর সত্যজিৎ করবেন ষাটের দশকের সূচনায়)। তাই বাস্তবে দেখা জ্বলন্ত ট্রাম আর আর তৎকালীন বাংলা সিনেমার (ভারতীয় ছবিরও বটে) একমাত্র আন্তর্জাতিক মুখকে তখন আর দর্শক সমালোচকেরা মেলাতে পারছেন না, সমকালীন অন্যান্য শিল্প (যেমন কবিতা, উপন্যাস, থিয়েটার) যেভাবে সময়ের কথা বলছে – সিনেমার পর্দায় তখন নিছকই মেদুর স্বপ্নবিলাস।

       কিন্তু, রাজনীতি এবং চলচ্চিত্র – এই দুটো বিষয় নিয়ে সেই সময় থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশী দূরত্বে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের থমকে দাঁড়াতেই হয়, দুদন্ড ভাবতে হয় – এত সহজে এহেন সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া যায় কীনা। চলচ্চিত্র এবং রাজনীতির সম্পর্ক জন্ম থেকেই প্রায় অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত, আমরা জানি সেই সূচনাতেই হলিউডের পাশাপাশি সোভিয়েত দেশের চলচ্চিত্র কীভাবে রাজনীতিকে তার শরীরে মিশিয়ে ফেলে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের দৃপ্ত সূচনা করে ফেলেছিল। সের্গেই আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রের সেই আদি লগ্নে, বিংশ শতকের গোড়ার দশকেই পরপর বানিয়ে ফেলেছিলেন দ্য স্ট্রাইক (১৯২৫) ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন (১৯২৫) অক্টোবর (১৯২৭)র মত একাধিক বৈপ্লবিক, রাজনৈতিক ছবি। উদাহরণে পাঠককে ভারাক্রান্ত করতে চাই না, কিন্তু একা আইজেন্সটাইন নন, বরং পুদোভকিন, দভজেঙ্কো, জিগা ভের্তভ সহ অধুনা সোভিয়েত আভা-গার্দ চলচ্চিত্র নামে যে অংশকে ডাকা হয় – সেই ধারার একাধিক শিল্পী জোরকদমে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন, কীভাবে চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা যায়। অবশ্যই তাঁদের প্রেরণা ছিলেন স্বয়ং লেনিন, যেখানে তিনি সরাসরি চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক প্রচারের কাজে লাগানোর ডাক দিয়েছিলেন। আর এর পরে সিনেমার ইতিহাসে মূলধারার ছবির পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে (যদিও এই দুইভাগে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ধারাকে ভাগ করা আধুনিক জ্ঞানচর্চায় ক্রমশঃই বিলুপ্ত হয়ে আসছে) বহুবার রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের নানান রূপ উঠে এসেছে, সবকিছু আমাদের আলোচনায় আনা সম্ভব না, কিন্তু আমরা উল্লেখ করতে পারি বিখ্যাত সেই ইটালিয়ান নিওরিয়ালিজম বা ষাটের দশকে জঁ লুক গোদার, মৃণাল সেন, গ্লবার রচা প্রভৃতি চলচ্চিত্রকারের প্রচেষ্টা, সিনেমা নুভো, জিগা ভের্তভ কালেক্টিভ ইত্যাদি স্বঘোষিত রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের নানান ধারাকে। আমরা যেহেতু মূলত ষাট-সত্তরের দশক নিয়েই কথা বলছি, তাই এরপরে আর এগোনো এই মূহুর্তে অপ্রয়োজনীয় – তবে এইটুকু বলে রাখা যায়, রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বিষয়ে সিনেমা বানানোয় এবং সিনেমা নিয়ে ভাবনা, জ্ঞানচর্চার জগতে – দুইজায়গাতেই বিস্তর টানাপোড়েন চলেছে। সেই বহুধা বিস্তৃত আলোচনার সামান্য কিছু সুত্র নিয়েই আমরা ষাট এবং সত্তরের দশকের সত্যজিৎ রায়ের ছবি নিয়ে কিছু ভাবনা পেশ করার চেষ্টা করব।

 

       যে কোনো শিল্পের মতই চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক নিয়মেই বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) এবং তা নির্দিষ্ট কায়দায় বলার ভঙ্গি, অর্থাৎ আঙ্গিক (ফর্ম) এই দুই নিয়ে নিয়ত একটি টানাপোড়েন চলতে থাকে। চলচ্চিত্র সংক্রান্ত যে কোনো বিতর্কেই, তাই কখনও শিল্পী/সমালোচকের অজান্তে হলেও এই দুটি বিষয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নানান মন্তব্য চোখে পড়ে। যেমন ঋত্বিক ঘটক একাধিক জায়গায় বিষয়বস্তু থেকেই আঙ্গিক উঠে আসার কথা বলেছেন – আবার কোথাও বিষয়বস্তু নিরপেক্ষভাবে আঙ্গিকের উপর জোর দিয়ে ভাবনাচিন্তার কথা বলেছেন। সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্র সংক্রান্ত একাধিক প্রবন্ধে বারবার আঙ্গিকের গুরুত্বের দিকটা জোর দিয়েছেন – যেমন তাঁর এই ১৯৫৯ সালেই প্রকাশিত প্রবন্ধের শিরোনামের কথা – “চলচ্চিত্র রচনাঃ আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি”। এই প্রবন্ধের তিনটে শব্দই – আঙ্গিক, ভাষা, ভঙ্গি – আমাদের ইঙ্গিত করে এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রের দিকে – অর্থাৎ ‘কী’ বলা হচ্ছে, তার থেকে যেন জরুরী হয়ে ওঠে, ‘কীভাবে’ বলা হচ্ছে।

       এই কী এবং কীভাবে – এই দুই নিয়ে শিল্পজগতে শিল্পী-চিন্তক দের মধ্যে পারস্পরিক বিতর্ক, মতান্তরের কোনো শেষ নেই। বহু বহু শিল্পী তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিয়ে জরুরী আলোচনা করেছেন, আবার একইভাবে, অনেক শিল্পী তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে আঙ্গিকের গুরুত্ব উল্লেখ করে তাকেই প্রধান হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। সেই জটিল বিতর্কের মধ্যে বিশদে না গিয়েও বলা যায় – শিল্প নিয়ে ভাবতে বসলে আমরা একটা কথা বুঝতে পারি – দুনিয়াজোড়া শিল্পের ইতিহাসে বারবার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যবস্তুর বিরাট কিছু হেরফের নতুন করে হয় না। অবশ্যই, সামাজিক রাজনৈতিক নানান পরিবর্তনের সুত্রে একশো বছরের আগের পৃথিবী আর সমকালের মধ্যে নানান পার্থক্য হয়ে গেছে – হয়তো বেশভুষা থেকে শুরু করে মানুষের আচার আচরণ, কথাবার্তার ধরণ, চালচলন – অনেককিছুই গেছে আমূল বদলে। কিন্তু যে কোনো শিল্পেরই যে মূল সূত্র – অর্থাৎ শিল্পী যেভাবে তাঁর সমকালের প্রতি প্রতিক্রিয়া জানান – সেই সূত্রের প্রধান যে হৃদয়ানুভূতি বা বুদ্ধিজগতের আলোড়ন – সেখানে প্রতি মুহূর্তে নতুন কিছু করে তোলার প্রক্রিয়া চট করে দেখা যায় না। অর্থাৎ ষাটের দশকের রাজনৈতিকভাবে অস্থির কলকাতা নিশ্চই স্বাধীনতা আন্দোলনের অস্থিরতার থেকে অনেক আলাদা – কিন্তু শিল্পী যখন সেই অস্থিরতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে চান – তিনি রেগে থাকতে পারেন, বিষণ্ণ থাকতে পারেন, বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন – কিন্তু খুব নতুন নতুন বিষয় বা অনুভুতি তাঁর আয়ত্তে রোজ রোজ আসে না। তাই জরুরী হয়ে ওঠে তিনি কী ভাবে, কী কায়দায়, কী ভঙ্গীতে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনা করছেন, সেই দিকটিই। যেভাবে কোনো ফিল্ম দেখে এসে পাঁচজন আলাদা আলাদা দর্শক নতুন কোনো শ্রোতার কাছে যদি একই ফিল্মের গল্পাংশটুকু মাত্র বলেন, তাহলে পাঁচজন আলাদা দর্শকের অভিজ্ঞতায় সেই পাঁচটি গল্প প্রায় আলাদা হয়ে যায় – একই গল্প, বলার ভঙ্গীতে হয়ে যায় পৃথক।

সের্গেই আইজেনস্টাইনের নির্মিত ছবি এবং চলচ্চিত্রভাবনা – এই দুইকে পাশাপাশি রেখে পড়তে গেলে আমরা টের পাই, কীভাবে আইজেনস্টাইন বিষয়বস্তুতে কারখানার ধর্মঘট বা পোটেমকিন জাহাজের বিদ্রোহের গল্প বলার পাশাপাশি, আঙ্গিকে হলিউডের চিত্রভাষার বিপ্রতীপে বৈপ্লবিক একটি প্রতিপ্রস্তাব রাখছেন। চলচ্চিত্রের সেই সূচনার যুগে যখন পাশাপাশি শট জুড়ে জুড়ে নিশ্ছিদ্র ভাবে সুষামঞ্জস্যে কীকরে একটি গল্পকে নিঁখুত ভাবে বলা যায়, তাই ছিল হলিউডের ছবির প্রধান উদ্দেশ্য। আর আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্রভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ‘মন্তাজ’ নামক একটি বিষয়, যেখানে তিনি প্রস্তাব করেন যে পাশাপাশি দুটো ইমেজে কী দেখা যাচ্ছে (বিষয়বস্তু), সে বিষয়ের থেকেও তিনি বেশী আগ্রহী সেই দুটো ইমেজকে একসাথে জুড়লে সংঘর্ষ হয় – সেখান থেকে কী অর্থ তৈরী হয় (আঙ্গিকের অর্থ)। অর্থাৎ যদি ক + খ = গ হয়, তাহলে ‘ক’ এবং ‘খ’ শটের অর্থের সংঘর্ষে নতুন একটি চিন্তার জন্ম হবে – ‘গ’, যার সাথে ‘ক’ বা ‘খ’র সরাসরি কোনো মিল নেই। তাঁর পূর্ববর্তী এবং সমকালীন অন্যান্য তাত্ত্বিক এবং শিল্পীদের সাথে তর্ক করে আইজেন্সটাইন বলছেন, ‘আমার মতে, মন্তাজ একটা আইডিয়া যা আলাদা স্বাধীন শটের সংঘর্ষের ফলে গড়ে ওঠে – এমনকী এমন শট যা নাটকীয় ভাবে একে অপরের থেকে আলাদা’। তাঁর এই তর্ক প্রমাণ করতে এর পরের লাইনেই তিনি জোর দিয়ে বলছেন, ‘আমরা চলচ্চিত্রের মূল শৈলী, স্বভাব এবং মেজাজকে বুঝতে চাইছি, এই টেকনিক্যাল ভিত্তির উপর নির্ভর করেই’। অর্থাৎ মন্তাজকে তিনি নানান পদ্ধতির একটি নয়, বরং চলচ্চিত্র নির্মাণের একমাত্র জরুরী একটি পদ্ধিতি বলছেন – সোজা কথায় একটি শটে যদি থাকে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা নিষ্ক্রিয় জনতা – আর তার সাথে যদি পরপর জুড়ে দেওয়া যায় ঘুম থেকে জেগে ওঠা সিংহের কোনো মূর্তির তিনটে দ্রুত শট (চিত্র দ্রষ্টব্য) – তাহলে পাশাপাশি এই শটগুলির নিজস্ব অর্থের থেকেও তাদের সংঘর্ষে যে নতুন অর্থ তৈরী হবে – সেইখানেই চলচ্চিত্রের আঙ্গিকের নতুন সম্ভাবনা রয়েছে। প্রলেতারিয়েত জনতা সিংহের মত হুংকারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিপ্লবে – শুধুমাত্র মেটাফরের প্রয়োগই নয় – বরং পাশাপাশি ইমেজের এই সংঘর্ষে চলচ্চিত্র ভাষার সম্পূর্ণ মৌলিক, নতুন একটি সম্ভাবনার দরজা খুলে যায় – যা স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের নজর বিষয়বস্তু থেকে আঙ্গিকের দিকে নিয়ে আসে।

 

আমরা বুঝতে পারি, রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণে শুধুমাত্র ধর্মঘট বা জাহাজের বিদ্রোহের গল্পই আইজেনস্টাইনের জন্য জরুরী থাকছে না – বরং তিনি মার্ক্সবাদী প্রেক্ষিত থেকে জোর দিচ্ছেন সেই গল্পের উপস্থাপনায়, গল্প বলার দ্বান্দ্বিক কায়দায়, বক্তব্যের ভঙ্গিতে, আঙ্গিকে (ওঁর প্রবন্ধটির নামই, চলচ্চিত্র আঙ্গিকের দ্বান্দ্বিক রূপ)। এমনকি এই প্রবন্ধেই, আমরা যে অংশ উদ্ধৃতি দিলাম, আইজেনস্টাইন ‘নাটকীয় ভাবে আলাদা শট’ লিখে ‘নাটকীয়’ শব্দটির তলায় টীকা যোগ করছেন – ‘এপিক ও ড্রামাটিক (নাটকীয়) শব্দদুটো এখানে ফর্মের মেথডলজি বোঝাতে ব্যবহৃত, কনটেন্ট বা প্লট বোঝাতে নয়’। মার্ক্সের কাছে ইতিহাসকে যেভাবে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা জরুরী, তেমনি আঙ্গিকের প্রয়োগে এখানে ইতিহাসের সেই দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে, শুধুমাত্র বিষয়বস্তুতে নয়। আর এই ভাবনা থেকেই আমরা একধাপ এগিয়ে বলতে পারি, আইজেন্সটাইন সহ সোভিয়েত চলচ্চিত্রকারদের ছবির রাজনীতি বুঝতে গেলে জরুরী তাঁদের আঙ্গিক পড়তে শেখা – কারণ রাজনীতি সেখানে আঙ্গিকে লুকিয়ে আছে। এই বিষয়টি নিয়েই বাকি প্রবন্ধে আমরা নানান কথাবার্তা বলব।

তাই শিল্প পাঠের সময়ে আঙ্গিকের দিকে অতিরিক্ত মনোযোগ আমাদের দিতেই হবে - আঙ্গিকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা তার সজ্জার নির্দিষ্ট ভঙ্গি না পড়তে জানলে শিল্পের ইতিহাসের অধিকাংশ অলিগলিই আমাদের অধরা থেকে যায়।

 

       সত্যজিৎ থেকে দীর্ঘ বাঁক নিলেও কিন্তু আমরা আমাদের ভাবনার পথেই আছি – আমরা ভাবছিলাম আঙ্গিকের রাজনীতি, তা কীভাবে শিল্পের শরীরে উঠে আসে। আমরা যদি এ লেখার একদম শুরুতে, চলচ্চিত্র সমালোচক চিদানন্দ দাশগুপ্ত এবং অধ্যাপক-চলচ্চিত্র গবেষক মৈনাক বিশ্বাসের দুটি উদ্ধৃতির দিকে তাকাই – তাহলে এতক্ষণ আলোচিত এই দুটি বাইনারীতে বক্তব্যদুটিকে পড়ে ফেলতে পারব। চিদানন্দ যেখানে সত্যজিতের ছবিতে এক অর্থে সময়ের প্রতিরূপ খুঁজছেন – খুঁজছেন দ্রোহে ফেটে পড়ার কলকাতা – একটু ভাবলেই আমরা বুঝতে পারি – আসলে তিনি ইঙ্গিত করছেন সত্যজিতের ছবির বিষয়বস্তুতে এবং ইমেজে, সরাসরি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের অভাবের কথা। চিদানন্দ চাইছেন, কেন বাস্তবের প্রতিরূপায়ণ (রিপ্রেজেন্টেশন) করে সত্যজিৎ তাঁর সময়কে ছবির শরীরে গেঁথে নিচ্ছেন না, কেন তিনি উনিশ শতকের কলকাতা বা সমকালেও শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ঘরেই ক্যামেরা আটকে রাখছেন (মহানগর )। অর্থাৎ - ছবির বিষয়বস্তুতে, ছবির কনটেন্ট-এ কেন রাজনীতি সরাসরি আসছে না, তাই চিদানন্দবাবুর অভিযোগের মূল বিষয় হয়ে উঠছে।

       অন্যদিকে মৈনাক ইঙ্গিত করছেন প্রায় বিপরীত আরেকটি দিকে, যা নিয়ে ভাবতে শুরু করলে ছবির শরীরে রাজনীতি উঠে আসার আসার ধারণারই ব্যাপক একটি পরিবর্তন হয়ে যায়। এখানে আমাদের পক্ষে জরুরী হয়ে ওঠে বিষয়বস্তুতে নয়, বক্তব্য বস্তুতে নয় – বরং আঙ্গিকে, গল্প বলার ভঙ্গিতে, গল্পের কাঠামোর বিশ্লেষণে কীভাবে রাজনীতি উঠে আসে – তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা। মৈনাকের প্রস্তাব আমাদের ভাবনাবিশ্বের জরুরী দরজা খুলে দেয় – যেখানে আঙ্গিকের পরিবর্তনের সূত্রে, ছবির শারীরিক গঠনের ভাঁজে কীভাবে রাজনীতি লুকিয়ে থাকে, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা জরুরী হয়ে ওঠে। আইজেনস্টাইনের ভাবনার সূত্র ধরে জঁ লুক গোদার যেভাবে বলেছিলেন, “একটি ইমেজ সবসময়ে দুটি ভিন্ন ইমেজের সংঘর্ষের ফল” – এইজাতীয় বক্তব্য থেকে আমরা পড়ে নিতে পারি আঙ্গিকের রাজনীতির কথা। কিন্তু সরাসরি আইজেনস্টাইন বা গোদার থেকে সত্যজিতে প্রবেশ আমাদের পক্ষে একটু মুশকিলের হতে পারে (যদিও প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির আলোচনায় এই ভাবনা জরুরী হয়ে উঠবে)। আমাদের প্রয়োজন আরও কিছু তাত্ত্বিক ভাবনার সাথে পরিচিত হওয়া – নইলে সত্যজিতের ছবির সাপেক্ষে তাঁর আঙ্গিকের রাজনীতি বুঝে ওঠা খানিক মুশকিলের হয়ে যাবে।

       মৈনাক তাঁর একটি প্রবন্ধে ফরাসী দার্শনিক জিল দ্যেলুজের সূত্র ধরে লেখেন, ‘(রাজনৈতিক) সমস্যা সম্পূর্ণ ভাবে, তৈরী সন্দর্ভে পর্দায় উঠে আসা উচিৎ নয়, যাতে সামান্য চিন্তাভাবনাতেই তা সমাধানের স্তরে উন্নীত হতে পারে। এইভাবে ভাবলে সমাজের মেকি সমষ্টির মায়া তৈরী হয়, যা স্বভাবগত ভাবেই রাজনীতি বিরোধী’। সত্যজিতের ছবি নিয়ে প্রকাশিত তৎকালীন অসংখ্য লেখায় আমরা দেখতে পারি, কেন সে ছবিতে রাজনীতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে আসছে না, তা নিয়ে নানান ক্ষোভ। শুধু রাজনীতির বিষয় উঠে আসাই নয়, বরং একধরণের তরল-সরল বামপন্থী ভাবনার আধারেই অনেকে চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক সমস্যা এবং তা থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাব্য উপায় বাৎলে দেবার কথাও বলতেন, যা নিয়ে একাধিক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ নিজেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। শিল্পীর কাজ সমাধান বাৎলে দেওয়া নয়, বরং সমস্যাকে তুলে ধরা – এ কথা বারবার বলতে হয়েছে সত্যজিৎকে। কিন্তু, আমরা আরও প্রাথমিক একটি স্তরে আছি – যেখানে এই ছবির শরীরে, ইমেজে সমস্যাই উঠে আসছে না (চিদানন্দের লেখা) – এই অভিযোগের মোকাবিলা করা জরুরী হয়ে উঠছে। ইমেজ শুধু তাই নয় যা ইমেজ হিসেবে দেখা যায়, বরং দুটি ইমেজের সংঘর্ষ – এ কথা আমরা গোদার-আইজেনস্টাইনের সূত্র ধরে জেনেছি, কিন্তু সে প্রসঙ্গ প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির আলোচনার জন্য তোলা থাক। ছবির শরীরে বিষয়বস্তু হিসেবে রাজনীতি যদি সরাসরি না থাকে, সেক্ষেত্রে সেই ছবিতে রাজনীতি থাকতে পারে কীনা, তাই আমাদের আলোচ্য বিষয়, এবং এখানেই কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬১) ছবিটির নির্দিষ্ট একটি আঙ্গিকগত বিশ্লেষণ করে আমরা ভাবতে চেষ্টা করব, আঙ্গিকের রাজনীতি কতটা দ্রোহ এবং যন্ত্রণার কাব্যের কাছাকাছি যেতে পারে।

       কাঞ্চনজঙ্ঘা  ছবিটির গল্প সবাই জানেন – উচ্চিবিত্ত পরিবারের নয়টি ভিন্নধরণের চরিত্র, সঙ্গে নিম্ন মধ্যবিত্ত এক যুবক দার্জিলিং শহরে এক সন্ধ্যায় ঘণ্টাদুয়েক ঘুরে বেড়ায়। এইটুকু অংশে অনেককিছু হয় – যেমন পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক কর্তা ইন্দ্রনাথ হঠাৎ ছবির শেষে আবিষ্কার করেন, তাঁর আদেশ আর কেউ শুনছে না, তাঁর স্ত্রী দীর্ঘকালীন বৈবাহিক সম্পর্কের নিষ্পেষণের থেকে বেরিয়ে আসার মানসিক শক্তি খুঁজে নেন – অন্যদিকে তাঁদের দুই মেয়ের একজনের ভেঙে যাওয়া বিয়ে জোড়া লাগতে থাকে, আর একজনকে প্রায় জোর করে ধনী এক যুবকের স্ত্রী করে দেওয়ার পরিকল্পনা কার্যত ভেস্তে যায়। একই সাথে প্রায় চার পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন গল্পের স্রোত পাশাপাশি বইয়ে দিয়ে সত্যজিৎ আপাত অর্থে উচ্চবিত্ত পরিবারের কিছু চরিত্রের সম্পর্কের টানাপোড়েনের যে গল্প বলেন, তা দ্রোহে ফেটে পড়া কলকাতা থেকে অনেক দূরে (ছবিটি কার্যতই কলকাতা থেকে অনেক দূরে, গোটা গল্পই দার্জিলিং-এ) – কিন্তু আমাদের এতক্ষণের ভাবনার পরিমণ্ডল থেকে কী আমরা কোনো সুত্র পেতে পারি, যা নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা  ছবিটিকে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে পড়া যায়?

       ছবির প্রান্তিক, ছোট্ট চরিত্র নেপালী একটি ভিখিরী বালক, যাকে ছবির নানান সময়ে আমরা খানিক অযাচিত ভাবেই ছবির অন্যতম ধনী, প্রভাবশালী চরিত্র প্রণব ব্যানার্জীর আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখি। প্রণব ইন্দ্রনাথের মেয়ে মনীষার পাণিপ্রার্থী – ছবির শুরু থেকে বলা হয় – প্রণব সেই দিনেই মনীষাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। ছবির একটি দীর্ঘ অংশে আমরা দেখি, মনীষা এবং প্রণব বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে পাহাড়ী নির্জন রাস্তায় হেঁটে চলেছে, তাঁদের সাথে মাঝে মাঝে খালি উড়ে এসে জুড়ে বসছে নেপালী এই ভিখিরী ছেলেটা। ছবির কোথাও সরাসরি, বিষয়বস্তু হিসেবে শ্রেণী বৈষম্য বা ক্ষুধার হাহাকারের কথা বলা হয়নি – এমনকী একই ছবিতে ধনী এবং গরীব চরিত্র একসাথে থাকলেও তাতে করে বিশেষ কিছু বলা হয় না। কিন্তু আমরা যে পরিকল্পে ভাবছি – তাতে আমাদের জন্য জরুরী আঙ্গিক – গল্প বলার ভঙ্গী। কাঞ্চনজঙ্ঘা  ছবিতে আমরা দেখব, গল্পের একটি উপাদান – এই ভিখিরী ছেলেটি, ফাঁকা পাহাড়ী রাস্তায়, কীভাবে প্রণবের মনীষাকে প্রায় জোর করে দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবে বারবার উড়ে এসে জুড়ে বসে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বস্তুত প্রণবের সাথে এই ছেলেটিকে জুড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বৃহত্তর একটি সাংগীতিক কাঠামোর পরিকল্পে সত্যজিৎ কাজ করছেন – যেভাবে সিম্ফনির মূল সুরের সাথে কাউন্টারপয়েন্ট যুক্ত হয়ে মিশ্র একটি শ্রবণ-অনুভূতি তৈরী হয়। কিন্তু এখানে মূল সুর (ধণী প্রণব) আর তার কাউন্টারপয়েন্ট (ভিখিরী ছেলে) হিসেবে এই নির্দিষ্ট দুটো চরিত্রকে পাশাপাশি রেখে দেওয়ার ফলেই এই আঙ্গিকগত নির্বাচনটি রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে। ছবিতে একই সাথে দুটো চরিত্র আলাদা করে থাকলে যে কথা বলা যেত না, সেইসব না বলা রাজনৈতিক কথা ছবির মূল শরীরে, যেন পাঠকের বিট্যুইন দ্য লাইন পাঠের অপেক্ষায় আছে – কেন মহান শক্তিধর প্রণব আর সর্বহারা ভিখিরী বাচ্চা ছেলেটি পরস্পরকে ছেড়ে যায় না। (চিত্র দ্রষ্টব্য) এখান থেকে আমরা স্পষ্ট প্রমাণ পাই – শুধুমাত্র শ্রেণীর সাপেক্ষে নির্দিষ্ট দুটি চরিত্রকে পাশাপাশি রাখলেই হবে না – বরং আঙ্গিকের বিচারে এমন কিছু করা যাই – যাতে সেই আঙ্গিকগত সিদ্ধান্ত থেকে জরুরী রাজনীতির বয়ান উঠে আসে। বস্তুত গোটা কাঞ্চনজঙ্ঘা  জুড়ে এরকম অসংখ্য নিদর্শন আছে সেখানে রাজনীতি সরাসরি বিষয়ববস্তুতে নেই, কিন্তু ছবির শরীরে যা আঙ্গিকের মাধ্যমে রাজনৈতিক দ্যোতনা তৈরী করছে – যেমন এই ছেলেটির ফুল খাওয়ার ইমেজ এবং প্রণব-মণীষা’র ফুল নিয়ে রোম্যান্টিক কল্পনার ইমেজ পাশাপাশি রাখলেই আমরা খাদ্য আন্দোলনের ইতিহাসের জরুরী একটি রাজনৈতিক বয়ান খুঁজে পেতে পারি। নিম্নবিত্ত অন্য যুবকটির ইন্দ্রনাথের চাকরীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানে, হো হো করে হঠাৎ ফেটে পড়া হাসিতে, ইন্দ্রনাথের স্ত্রী লাবণ্যর রবীন্দ্রগানে আশ্রয়ের বা তাঁর দাদা জগদীশের পাখি খোঁজার দ্যোতনায় – এই দৃশ্যগুলির আঙ্গিকগত অবস্থানে ছবির শরীরের ভাঁজে ভাঁজে রাজনীতি রাখা আছে, যা সম্পূর্ণ তৈরী সন্দর্ভে সমাধানের অপেক্ষায় থাকা রাজনীতি নয় – বরং ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সাথে পিতৃতান্ত্রিকতা এবং নয়া পুঁজিবাদের পথ – এই সমস্ত নিয়ে নানান তীর্যক রাজনীতি। অন্যকথায়, কাঞ্চনজঙ্ঘা  ছবিতে দ্রোহ বা যন্ত্রণা’র সরাসরি কোনো প্রতিরূপায়ণ নেই, বরং তীর্যক ভঙ্গীতে ইতিহাস এবং রাজনীতি যেন ভর করে থাকে – সেখানে সরাসরি প্রতিরূপায়নের বদলে এই ভর করে থাকার রাজনীতি বেশী শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ভিখিরী ছেলেটির ফুল খাওয়ার ইমেজে বা ইন্দ্রনাথ চরিত্রে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ঔপনিবেশিক শাসনের দ্যোতনার কোনো পরিত্রাণ নেই, সহজ কোনো সমাধান নেই – আমরা শুধু ইতিহাসের ভূতগ্রস্থ রূপ দেখে যেতে পারি। ঐ একই প্রবন্ধে মৈনাক লেখেন, “ঐতিহাসিক ট্রমাকে প্লট এবং বিষয়বস্তুর বদলে পর্দায় ভর করে থাকার একটি দুর্দান্ত পদ্ধতি (কিছু পরিচালক) আবিষ্কার করে ফেলেছেন, যা সরাসরি (বাস্তবের) প্রতিরূপায়ণের নিয়ম এবং (রাজনৈতিক) সমস্যাকে পর্দায় চিনে ফেলার সামাজিকতার বিপ্রতীপে যায়”। যদিও বক্তব্যটি সমকালীন কিছু ইউরোপীয়ান চলচ্চিত্রকার সম্পর্কে, কিন্তু সত্যজিৎ সম্পর্কেও আমরা এ ভাবনা ভাবতে পারি – মৈনাক নিজেই অন্য একটি প্রবন্ধে তা ভেবেছেন। আমরা এতক্ষণ আলোচনা করেছি, প্রতিরূপায়ণের ওপারে পর্দার উপরে ভর করে থাকা রাজনৈতিকতা কতখানি শক্তিশালী হতে পারে।

       শুধুমাত্র এটুকুতেই নয়, বরং এর প্রায় দশ বছর পরের ছবি, প্রতিদ্বন্দ্বী ছবিটি, যাকে তৎকালীন দর্শক-সমালোচকেরা সক্রিয় ভাবে রাজনৈতিক না বলে পরোক্ষভাবে সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার দোষে অভিযুক্ত করেছিলেন। আজকে, ছবিটির থেকে প্রায় পঞ্চাশবছরের দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমরা সেই ছবির শরীরেই পড়তে পারি রাজনৈতিক দ্রোহের স্বর – ছবির ইমেজেই শুধু সরাসরি নয়, বরং পাশাপাশি ইমেজের সংঘর্ষে। এ ছবির শুরুতে নেগেটিভ ইমেজের ধারালো আঘাত পেরিয়ে যখন ছবির টাইটেল শুরু হয়, আমরা দেখি নায়ক সিদ্ধার্থ ভিড় বাসে ঝুলে চাকরীর পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। সত্যজিৎ, তাঁর চলচ্চিত্রে সম্ভবত এই প্রথম, বাস্তবের প্রতিরূপায়ণে সংযুক্তির বদলে একধরণের বিচ্যুতি বা ভাঙনের যুক্তিতে কথা বলতে লাগলেন – আমরা দেখলাম শরীর, হাত, পা কণ্ঠ – ভিড় বাসে সব একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে গেছে (চিত্র দ্রষ্টব্য)। ক্লোজ শটে যে ভিড় বাসের হাতল ধরা হাত দেখছি – সেই নামহীন অগণিত চরিত্র ছবির প্রধাণ চরিত্রের সাথে সরাসরি সম্পর্কে নেই, কিন্তু তীর্যক সম্পর্কে, সত্তরের কলকাতা আর ইতিহাসের এক ঘটমান বর্তমান ভাঙনকে যেন (নকশালবাড়ি অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে ১৯৬৯তে) সিনেমার পর্দায় ভূতগ্রস্থ করে উপস্থাপনা করছে। ছবির শিরোনামের এই প্রথম দৃশ্যটিকে শট বাই শট পড়লে আমরা বুঝতে পারি পাশাপাশি ইমেজের সংঘর্ষে তা কীকরে আঙ্গিকগতভাবে রাজনৈতিক হয় – অস্থির মিঁজসিন এবং দ্রুত এডিটিং – তার সঙ্গে শরীরের বিচ্যুত অংশের সাথে যেন বাস বা রাস্তার ইচ্ছাকৃত বাঁকা ফ্রেমের সর্বক্ষণ সংঘর্ষ চলছে।

     

       কলকাতা এখানে বাস্তব প্রতিরূপায়ণের বদলে উঠে আসছে ছবির শিরায় শিরায়, ধমণীতে, ধমণীতে, রক্তে – আমরা দেখছি সত্যজিতের প্রথম পর্বের ছবির ধ্রুপদী নান্দনিকতা ভেঙেচুরে যাচ্ছে, শহর ক্রমশঃ হিংস্র হয়ে সিদ্ধার্থকে গিলে খেতে চাইছে। বস্তুত অরণ্যের দিনরাত্রি ছবিটির অসামান্য একটি আলোচনায় শিবাজী বন্দোপাধ্যায়ও একই জিনিস দেখাচ্ছেন, কীভাবে একটি জঙ্গলে মেমরি গেম খেলতে থাকা যুবকদের সামান্য একটি স্লিপ অফ টাং-এ ইতিহাসের রাজনৈতিক দ্যোতনা পুরে দেওয়া থাকে। সমকালীন সমালোচকেরা যারা এ ছবিগুলির রাজনীতিকে অপর্যাপ্ত বলছেন, তাঁরা, আমরা আবারও বুঝতে পারি – পড়ছেন বিষয়বস্তুর রাজনীতি, যেখানে কেন সিদ্ধার্থের ভাই ছবির মূল চরিত্র হল না – এহেন একটি অহেতুক বিতর্ক ছবির সূক্ষ্ম ভাঁজ গুলির দিকে দৃষ্টি দিতে দিচ্ছে না। বরং শহরের তীর্যক রূপায়ণ, ভাঙা শরীরের খণ্ড খণ্ড ইমেজের সংঘর্ষ দেখতে দেখতে, অন্তত পঞ্চাশবছরের দূরত্বে আমরা বুঝতে পারি সত্যজিৎ এই সময় কীভাবে ফর্মে পালটাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ছবির নন্দনের পাশাপাশি কীভাবে তাঁর ছবির নন্দনকে মিলিয়ে পড়া যাচ্ছে, কীভাবে সযত্নে লালিত সত্যজিতের ধ্রুপদী আঙ্গিক (এবং ভাববিশ্ব) এই সময়ের ছবিতে একটু একটু করে ভেঙেচুরে যাচ্ছে।

 

এ লেখাটি এক অর্থে প্রথমে উদ্ধৃত দুটি বাক্যের মধ্যেই একধরণের যাত্রা – চিদানন্দের পাঠ থেকে মৈনাকের পাঠে যাওয়ার পথে, বিষয়বস্তুর রাজনীতি থেকে আঙ্গিকের রাজনীতি পড়ার পথে একটি প্রচেষ্টা। বস্তুত বৃহত্তর তর্কে এই ছবিগুলো নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের প্রয়োজন বিষয়বস্তু আর আঙ্গিকের মধ্যে সমন্বয় তৈরী করে তা থেকে উদ্ভুত রাজনীতি নিয়ে ভাবা – বিশেষ করে এমন রাজনীতি যা সরাসরি না থেকে আনাচে কানাচে, আড়ালে আবডালে থাকে, ইমেজে না থেকে ইমেজের সংঘর্ষে থাকে। তাই আঙ্গিকের রাজনীতি পড়তে অভ্যস্ত হলে সত্যজিৎ সহ নানান শিল্পীর কাজ নিয়ে আমরা হয়তো নতুন করে ভাবার অভ্যেস শুরু করতে পারব। 

 

(ইংরেজী থেকে উদ্ধৃতাংশের সব অনুবাদ বর্তমান লেখকের)

 

টীকাঃ

সত্যজিৎ রায় স্বয়ং তাঁর এক প্রবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। “চলচ্চিত্রের ভাষা, সেকাল ও একাল”, প্রবন্ধ সংগ্রহ (সম্পাদকঃ সন্দীপ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স, মে ২০১৫) পৃঃ ১৩৩

এ বিষয়ে ঋত্বিক ঘটকের তরুণ বয়সে লেখা গবেষণাপত্রটি দ্রষ্টব্যঃ ঋত্বিক ঘটক (১৯৫৪), On the Cultural Front (Ritwik Memorial Trust, 2006) পৃঃ ২১

এই উদাহরণটি দিয়েছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ডেভিড ব্রডওয়েল। ডেভিড ব্রডওয়েল ও ক্রিস্টিন থম্পসন (২০১৩), “The Significance of Film Form”, Film Art: an Intriduction (10th Edition) পৃঃ ৫০-৭১

সের্গেই আইজেনস্টাইন (১৯২৯), “A Dialectical Approach to Film Form”, Film Form: Essays in Film Theory (ed. & trans. by Jay Leyda, 1977) পৃঃ ৪৯

এ নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বিতর্ক আছে, কিছু পরে ফরাসী দার্শনিক-চলচ্চিত্রবেত্তা আন্দ্রে বাঁজা আপত্তি জানাবেন। সেই প্রসঙ্গে এখানে আলোচনা করা আমাদের পরিধির বাইরে।

 

সের্গেই আইজেনস্টাইন (১৯২৯), “A Dialectical Approach to Film Form”, Film Form: Essays in Film Theory (ed. & trans. by Jay Leyda, 1977) পৃঃ ৪৯

জঁ লুক গোদার ১৯৮০ সালে আমেরিকার বিখ্যাত ডিক ক্যাভেট শো তে এই কথা বলেন। এই লিংক থেকে ২২-০৭-২০২০তে অ্যাকসেস করা হয়েছে। https://www.youtube.com/watch?v=xsfAnCwxYFA

 

 মৈনাক বিশ্বাস (২০১৪) “For a Political Cinema to Come” (Economic and Political Weekly, vol. 49, no. 33, 2014, পৃঃ ২৩-২৬)

যেমন একটি সাক্ষাৎকার পাওয়া যাবে, অভিজিৎ দাশগুপ্ত’র সঙ্গে, সংকলিত হয়েছে, সত্যজিৎ রায় সাক্ষাৎকার সমগ্র, পত্রভারতী, ২০২০, পৃঃ ৩৯৮-৪০০

 

বিশদ আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য, স্যাচস এবং ডালহাউস (২০০১), “Counterpoint” (The New Grove Dictionary of Music and Musicians, ed. Stanley Dadie, London)

মৈনাক বিশ্বাস (২০১০) "Ray and the shadow of political cinema." (The Marg Foundation 22 Jul. 2020)

এ বিষয়ে সুপ্রিয়া চৌধুরী লিখেছিলেন, “These are driven, haunted films; films recording the spectrality of the modern city, a place of memories, desires, ghosts”। সুপ্রিয়া চৌধুরী (২০০৬), “In the City”, মৈনাক বিশ্বাস (সম্পা) Apu and After: Re-visiting Ray’s Cinema, Seagull Books, Kolkata.

 

শিবাজী বন্দোপাধ্যায় (২০০৬), “Ray’s Memory Game”, Apu and After: Revisiting Ray’s Cinema (ed. Moinak Biswas, Seagull Books, পৃঃ ১৯২ – ২৫০)

যেমন ১৯৭৪ সালে একটি লেখায় দীপেন্দু চক্রবর্তীর মন্তব্য করেছিলেন, প্রতিদ্বন্দীর রাজনীতি দ্বিধান্বিত এবং হতাশাজনক। দীপেন্দু চক্রবর্তী (১৯৭৪), মানবতাবাদী সত্যজিৎ প্রসঙ্গে মৈনাক বিশ্বাসের "Ray and the shadow of political cinema." (২০১০) – এ উদ্ধৃত।

 

প্রবন্ধ গ্রন্থ তালিকাঃ

 

চিদানন্দ দাশগুপ্ত (১৯৬৬-৬৭), “Ray and Tagore”, Sight and Sound, 36:1

মৈনাক বিশ্বাস (২০১৭), “‘কলকাতা ৭১, ‘পদাতিক’ ও তৎকালীন চিত্রসমাজ”, চিত্রভাষ মৃণাল সেন বিশেষ সংখ্যা পৃঃ ৯৫
                - (২০১৪) “For a Political Cinema to Come” (Economic and Political Weekly, vol. 49, no. 33, 2014, পৃঃ ২৩-২৬)
                - (২০১০) "Ray and the shadow of political cinema." (The Marg Foundation 22 Jul. 2020)

সত্যজিৎ রায় (১৯৬৯), “চলচ্চিত্রের ভাষা, সেকাল ও একাল”, প্রবন্ধ সংগ্রহ (সম্পাদকঃ সন্দীপ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স, মে ২০১৫) পৃঃ ১৩৩
                - “পলিটিকাল ফিল্ম” (অভিজিৎ দাশগুপ্ত’র সঙ্গে সাক্ষাৎকার, সংকলিত হয়েছে, সত্যজিৎ রায় সাক্ষাৎকার সমগ্র, পত্রভারতী, ২০২০, পৃঃ ৩৯৮-৪০০)

ঋত্বিক ঘটক (১৯৫৪), On the Cultural Front (Ritwik Memorial Trust, 2006) পৃঃ ২১

ডেভিড ব্রডওয়েল ও ক্রিস্টিন থম্পসন (২০১৩), “The Significance of Film Form”, Film Art: an Intriduction (10th Edition) পৃঃ ৫০-৭১

সের্গেই আইজেনস্টাইন (১৯২৯), “A Dialectical Approach to Film Form”, Film Form: Essays in Film Theory (ed. & trans. by Jay Leyda, 1977) পৃঃ ৪৯

স্যাচস এবং ডালহাউস (২০০১), “Counterpoint” (The New Grove Dictionary of Music and Musicians, ed. Stanley Dadie, London)

সুপ্রিয়া চৌধুরী (২০০৬), “In the City”, মৈনাক বিশ্বাস (সম্পা) Apu and After: Re-visiting Ray’s Cinema, Seagull Books, পৃঃ ২৫১ – ২৭৬)

শিবাজী বন্দোপাধ্যায় (২০০৬), “Ray’s Memory Game”, মৈনাক বিশ্বাস (সম্পা) Apu and After: Re-visiting Ray’s Cinema, Seagull Books, পৃঃ ১৯২ – ২৫০)

দীপেন্দু চক্রবর্তী (১৯৭৪), মানবতাবাদী সত্যজিৎ প্রসঙ্গে মৈনাক বিশ্বাসের "Ray and the shadow of political cinema." (২০১০) – এ উদ্ধৃত।