সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ও একটি উনিশ শতকীয় উপন্যাস

সিদ্ধার্থ মফঃস্বলে ফেরে। অবশেষে। নাগরিক ক্যাকোফোনিতে হারিয়ে যেতে থাকা পাখির ডাক আবার সে শুনতে পায়। যখনই ভাবি সিদ্ধার্থ হয়তো মুক্তির স্বাদ পাবে এবার, তখনই ‘রামনাম সত্য হ্যায়’ ভেসে আসে বাইরে থেকে। সিদ্ধার্থ ঘুরে দাঁড়ায় ক্যামেরার দিকে। শটটি ফ্রিজ হয়। শটের উপর সুপার-ইমপোজ হয় ‘ইতি সিদ্ধার্থ’ কথাটি। রোম্যান্টিক তরুণটির স্বপ্নেরও কী মৃত্যু ঘটে চাকরির জাঁতাকলে পড়ে?  রাজনৈতিক সামাজিক বাস্তবতা বিমূর্ততার শীর্ষদেশ স্পর্শ করে। মনে পড়ে 400 Blows ছবির শেষ দৃশ্যে ফ্রিজ শটের ব্যবহার করেছিলেন ত্রুফোঁ যার প্রতি নিজের মুগ্ধতা গোপন করেন নি সত্যজিৎ। যদিও ছবিটির শেষ দৃশ্যটি লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পছন্দ হয় নি। সুনীল লিখেছিলেন, ‘... একেবারে শেষ দৃশ্যটি আমার উপন্যাস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথমে সেটা আমার পছন্দ হয়নি। পরে আমি ভেবে দেখেছি তাঁর পরিকল্পিত দৃশ্যটি, একটা অজানা পাখির ডাক দিয়ে যার শেষ – তার আবেদন অনেক গভীর। এখানে তিনি কাহিনীর উত্তরণ ঘটিয়ে দিয়েছেন।’ (আনন্দলোক, ৯মে, ১৯৯২) এই উত্তরণ বিশ্বসাহিত্যের একটি অন্যতম প্রধান মাইল ফলকের সাথে তুলনীয় মনে হয় আমার: উনিশ শতকে রচিত ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট’।

‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিটি তৈরী হয় ১৯৭০ সালে, কলকাতায় মুক্তি পায় ২৯শে অক্টোবর, ১৯৭০। সমাপতন দেখে ভালো লাগে যে ‘ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর একটি – সমালোচকদের মতে, সর্বশ্রেষ্ঠ – চিত্রায়িত রূপটি রাশিয়ায় মুক্তি পায় এই ১৯৭০ সালেরই ২১শে সেপ্টেম্বর, যার পরিচালক ছিলেন লেভ কুলিদঝানভ। ছবিটির দৈর্ঘ্য ছিল ৩ঘন্টা ৪১ মিনিট। দুটি ছবিই ছিল সাদা-কালো।

সিদ্ধার্থ ও রাসকলনিকভের দৃষ্টির শূন্যতা, দ্বিধা, হতাশা, রাগ যেভাবে ধৃতিমান চ্যাটার্জী ও জিওর্জি টারাটরকিন-এর মুখে ফুটে ওঠে ছবিদুটি জুড়ে, তা অনেক সময় এক্সপ্রেশনিস্ট ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়।

সত্তরের দশকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিটি তৈরী করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ছবির পরতে পরতে উত্তাল রাজনীতির গন্ধ, দেওয়ালে দেওয়ালে জ্বলন্ত স্লোগান, সত্তরের কলকাতার পথে পথে দ্রুত গতিতে ধাবিত হয় ক্যামেরা আর সেই সময়ের কলকাতা ধরা থাকে ছবিটির একের পর এক ফ্রেমে। দস্তয়েভস্কি দ্বারা কি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসটিতে কী ‘ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর ছায়া খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি? ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিটি ভীষণভাবে দস্তয়েভস্কিয়ান বলেই মনে হয় আমার। শরীরে সময়চিহ্ন ধারণ করে আছে বলেই বোধ হয় ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিটি এবং ‘ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসটি কাল্ট ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। বাবার আকস্মিক মৃত্যু যবনিকা টানে সিদ্ধার্থের পড়াশুনায়। চাকরীর সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় সে। রাসকলনিকভের সাথে সাদৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখি সেও পিতৃহীন, তারও ঘরে রয়েছে বিধবা মা, ছোট বোন সুতপা(ছোট ভাইও)। রাসকলনিকভের মতো সেও ঘুরে বেড়ায় এই শহরের আনাচেকানাচে। ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট কাহিনীর মূল চরিত্র রাসকলনিকভ এক মানসিক যন্ত্রণাদীর্ণ, দ্বিধাগ্রস্ত, প্রায়-ভবঘুরে এক মানুষ যার ছায়া যেন দেখা যায় সিদ্ধার্থের মধ্যে।

বলা হয়ে থাকে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে লাতিন আমেরিকা ধ্বংস হয়ে গেলেও মার্কেজের ‘একশ বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসটি থেকে লাতিন আমেরিকাকে আবার গড়ে তোলা যাবে। দস্তয়েভস্কির লেখা থেকেও যেন ঊনবিংশ শতকের সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটিকে তৈরী করে নেওয়া যায়। প্রতিদ্বন্দ্বী ছবিটি দেখতে দেখতেও মনে হয় না যে সত্তরের দশকের কলকাতাকেও ফিরিয়ে আনা যায় ছবিটি থেকে? দস্তয়েভস্কির কলম সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রেক্ষাপটে যে কাজটি করে গেছে সুনিপুণভাবে, সত্যজিতের ক্যামেরা কলকাতাকে সেইভাবেই ধরেছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।

রাসকলনিকভকে দিয়ে দস্তয়েভস্কি যেমন অপরাধ করান তাঁর উপন্যাসের শুরুতেই, সিদ্ধার্থও সমাজের চোখে গর্হিত এক অপরাধ করে ছবির শেষে, অপরাধের মাপকাঠিতে লঘু-গুরু ভেদ থাকলেও দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু অপরাধের ধরণ একই - Crime of Passion, কারণ রাসকলনিকভ কোনো পেশাদার খুনী ছিল না বা অন্য কোনো অপরাধেও সে সিদ্ধহস্ত নয়, অন্যদিকে, ষাটের দশকের শেষের দিকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক লাভা উদ্গীরণের পিছনে যে Political Activism, তার সাথে সিদ্ধার্থেরও কোনো সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। রাসকলনিকভের মতো সেও একা, অবস্থানগতভাবে, চেতনার দিক থেকেও সে একক, যদিও ইন্টারভিউ বোর্ডের কর্তাদের উদাসীন, অমানবিক আচরণ তাকে প্রতিবাদে ফেটে পড়তে বাধ্য করে।   

মানবহত্যার অসহনীয় ভার বুকে নিয়ে যেমন ঘুরে বেড়ায় রাসকলনিকভ, তেমনই আশৈশব বড় হওয়া, চিরচেনা শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় সিদ্ধার্থ, উভয় ক্ষেত্রেই যেন তাদের অপরাধের শাস্তিস্বরূপ নিজেদের ক্রুশকাঠ নিজেরাই বহন করে তারা আর এখানেই সাহিত্য ও সিনেমা একই বিন্দুতে সমাপতিত হয়। নাগরিক জীবনের নিরপেক্ষ রিপোর্টাজ ছবিটি যেন অস্তিত্ববাদী সাহিত্যের সাথে লীন হয়ে যায়।

সিদ্ধার্থ ও রাসকলনিকভ দুটি চরিত্রই তাদের জীবনে কোনো না কোনো সময়ে নিজেদের ক্ষুদ্র গন্ডী ছেড়ে বেড়োতে চায় যা চলচ্চিত্রে ও উপন্যাসে তীব্র অভিঘাত তৈরী করে দর্শক ও পাঠকের মনে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে সিদ্ধার্থ মুখোমুখি হয় ইন্টারভিউ বোর্ডের যেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয়: What will you regard as the most outstanding and the significant event of the last decade? সিদ্ধার্থ বেশ কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দেয়: The war in Vietnam, Sir. তারপর আরও দু’একটি প্রশ্নের পর প্রশ্নকর্তা যখন জানতে চান: Do you think that the war in Vietnam was unpredictable? সিদ্ধার্থের উত্তর: Not the war itself but what it has revealed about the Vietnamese people – about their extraordinary power of resistance – ordinary people, peasants and no one knew that they had it in them; and this isn’t a matter of technology, it’s just plain human courage and it takes your breath away.

সিদ্ধার্থ যেমন নির্দ্বিধায় জয়গান করে human courage-এর, রাসকলনিকভও নতজানু হয় human suffering এর কাছে:

with a sudden and rapid movement he bent down, fell to the ground, and kissed her foot. Sonia started back in fear, as though he were mad. Indeed, he looked quite mad.

“Why, why do you do that? To me!” she murmured, turning white, and her heart contracted painfully.

He rose at once.

“I prostrated myself not to you, but to all human suffering.”

রাসকলনিকভ প্রবল প্রতাপান্বিত ঈশ্বরকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে মানবতার কথা বলে, সিদ্ধার্থও প্রবল প্রতাপান্বিত যন্ত্রসভ্যতার চালিকাশক্তি হিসেবে বিজ্ঞানকে তুচ্ছ করে নিপীড়িত মানবতার শক্তিকে কুর্নিশ জানায়। ঈশ্বর ও বিজ্ঞান – বিশ্বাসীদের মতানুযায়ী দুই সর্বশক্তিমান মেরুকে ছাপিয়ে ওঠে তৃতীয় বিশ্বের নব্য শক্তি – মানবতা। আবারও কোথায় যেন এক হয়ে যায় দুই মূল চরিত্র।