সত্যজিতের তারাশঙ্কর

()

জলসাঘর

১৯৫৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের চতুর্থ ছবি ‘জলসাঘর’। তারাশঙ্করের ‘জলসাঘর’ গল্পটি বঙ্গশ্রীতে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৪ সালের বৈশাখ মাসে। ‘জলসাঘর’ গল্পটি নির্মাণের যেমন একটি প্রেক্ষাপট আছে, তেমনি এই ছোটগল্পটিকে আধার করে চলচ্চিত্র নির্মাণেরও একটি ছোট ইতিহাস আছে। সত্যজিতের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালি’ বানিজ্যিকভাবে ঐতিহাসিক সাফল্য লাভ করলেও পরবর্তী ছবি ‘অপরাজিত’ প্রশংসিত হয়েও বানিজ্যিক সাফল্য লাভ করে নি। তাই তিনি ভেবেছিলেন, ‘গ্রামের গল্প, জীবন সংগ্রামের গল্প আর চলবে না। বাঙালী দর্শক চিরকালই ছবিতে নাচগান পছন্দ করেছে- সেই উপাদান বজায় রেখে কি ভালো ছবি করা যায় না?’

অতঃপর সত্যজিৎ রায় বেছে নিয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘জলসাঘর’। এই গল্প থেকে ছবি করলে নাচ ও গানের সুযোগ আছে। প্রস্তাবে তারাশঙ্কর রাজী হলেন। সত্যজিতের অনুরোধে চিত্রনাট্যও লিখে দিলেন। সত্যজিৎ রায় দেখলেন চিত্রনাট্য মূল গল্প থেকে অনেকটাই পালটে গিয়েছে। সে কথা জানাতেই লেখক সত্যজিৎকে নিজেই চিত্রনাট্য লিখে নিতে বললেন।

‘জলসাঘর’ গল্পটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন কেউ একজন তারাশঙ্করকে বলেছিলেন, ‘জলসাঘরের ভাঙনের কথা তো লিখলেন, গড়নের কথাও লিখুন।’ তখন থেকেই তারাশঙ্করের মাথায় আরও দুটি গল্প লেখার আইডিয়া আসে। তিনি স্থির করেন প্রথম গল্পটি হবে রায়বংশের উত্থান, দ্বিতীয়টি ওই পরিবারের পরিপূর্ণ জৌলুস আর শেষেরটি রায়বংশের ভাঙন নিয়ে, যা আগেই লেখা হয়ে গিয়েছে।

‘জলসাঘর’ লেখার বছর খানেক পরেই তিনি লিখেছিলেন ‘রায়বাড়ি’। ‘আমার সাহিত্যজীবন’ গ্রন্থে তারাশঙ্কর লিখেছেন, ‘রায়বাড়ি গল্পের ১০৯২ লাটটি আমাদেরই ছিল। ওই লাট শাসন করতে না পেরে আমারই পূর্বপুরুষ সেকালের নাম করা এক দুর্ধর্ষ জমিদারকে পত্তনি দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের নিমতিতার জমিদার গৌরসুন্দর চৌধুরী।’ এখানেই তারাশঙ্কর লিখেছেন, ‘রায়বাড়ি’ গল্পে গৌরসুন্দরের সঙ্গে ১০৯২ নম্বর লাটের প্রজাদের মিটমাট করতে ঘটনাটি হুবহু সত্যি। গল্পে উক্ত জমিদারের নাম ছিল রাবনেশ্বর রায়। তাঁর আমলেই জলসাঘর নির্মিত হয়।

‘জলসাঘর’ গল্পে তারাশঙ্কর বলছেন, ‘রায়েরা তিনপুরুষ ধরে করেছিল সঞ্চয়। চতুর্থ পুরুষে করেন রাজত্ব। পঞ্চম ও ষষ্ঠ পুরুষ করলেন ভোগ ও ঋণ। সপ্তম পুরুষ বিশ্বম্ভর রায়ের আমলেই রায়বাড়ির লক্ষ্মী ঋণসমুদ্রে তলিয়ে গেল।’ ‘রায়বাড়ি’ গল্পের নায়ক দৌর্দন্ডপ্রতাপ রাবনেশ্বর রায় ছিলেন রায় বংশের চতুর্থ পুরুষ। তিনি প্রজা শাসনে নির্মম। এক বছর রথযাত্রার দিন সদর পুণ্যাহ উপলক্ষে প্রচুর দানধ্যান, কাঙালিভোজন, নাচগান ও জলসার বিপুল আয়োজন হল। সেই প্রথম জলসাঘরে মজলিস বসল। সেদিনই পিতৃগৃহ থেকে ফেরার পথে রাবনেশ্বরের স্ত্রী ও পুত্র ময়ূরাক্ষী ও গঙ্গার সঙ্গমস্থলে ঘূর্ণিতে পড়ে বজরা ডুবি হয়ে মারা গেল। একবার জ্বলে জলসাঘরের আলো নিভে গেল সেদিন। তারপর জলসাঘর আবার খুলল রাবনেশ্বরের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র তারকেশ্বর রায়ের আমলে। তারকেশ্বর রায় জলসাঘর গল্পের নায়ক বিশ্বম্ভর রায়ের পিতামহ। এই জলসাঘরে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তিনি বাইজীকে এক রাতে পাঁচশ মোহর বকশিশ দিয়েছিলেন। হাল আমলে বিশ্বম্ভর, রায়গিন্নীদের গহনা বিক্রি করে পুত্রের উপনয়নে সমারোহ করেন। সেদিনও জলসাঘরে মজলিস বসে। সমারোহের ঢেউ স্তিমিত হওয়ার আগেই কলেরার কবলে বেশ কিছু আত্মীয়সহ বিশ্বম্ভর রায়ের স্ত্রী ও পুত্র মারা যায়। বিশ্বম্ভর বেঁচে থাকেন রায়বাড়ির শেষ প্রতিনিধি স্বরূপ।

রায়বাড়ির শেষ প্রতিনিধিই আসলে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের দম্ভ ও আত্মঅবক্ষয়ের প্রতীক। তারাশঙ্করের গল্পটির মূল পটভূমি হল সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের গ্রাম বাংলার জমিদারী ব্যবস্থা এবং একজন উদীয়মান ব্যবসায়ীর দ্বন্দ্বকেই তারাশঙ্কর তুলে ধরেছেন ‘জলসাঘর’ গল্পে।

তারাশঙ্কর তাঁর কাহিনি শুরু করেছেন একদা জমজমাট প্রাসাদের জীর্ণ দশা বর্ণনার মধ্য দিয়ে, ‘মালীর অভাবে ফুলের বাগান শুকাইয়া গিয়াছে। আছে মাত্র কয়টা বড় গাছ- মুচকুন্দ, বকুল, নাগেশ্বর, চাঁপা। সেগুলিও এই বংশের মত শাখাপ্রশাখাহীন, এই প্রকান্ড ফাটল-ধরা প্রাসাদখানার মতই জীর্ণ।’

তবুও জীর্ণ ফাটল ধরা রায়বাড়ি লোকের কাছে রাজবাড়ি। বিশ্বম্ভর রায় আজও এলাকায় রায়-হুজুর। এই হল উঠতি বড়লোক গাঙুলীদের ক্ষোভের কারণ। ‘তাহারা সোনার দেউল তুলিয়াছেন মরা পাহাড়ের আড়ালে। পৃথিবী দেখে ওই মরা পাহাড়কেই, সোনার দেউলের দিকে কেহ চায় না। তাঁহাদের দামী মোটরের চেয়ে বৃদ্ধ হস্তিনীর খাতির বেশী। মহিম গাঙুলী ভাবে, মরা-পাহাড়ের চুড়ো ভাঙতেই হবে আমায়।’   

মহিম গাঙুলীর ছেলের মুখেভাতে বিপুল আয়োজন হয়েছে। রায়বাড়ির ঐতিহ্য মেনে হাতির পিঠে চড়ে বিশ্বম্ভরের নায়েব তারাপ্রসন্ন কাঁসার থালার উপর একটি মোহর নিয়ে যৌতূক দিয়ে আসে। মোহরখানি বিশ্বম্ভর বের করে দেন তাঁর শূন্যগর্ভ সিন্ধুকের কোণায় পড়ে থাকা মোহরের থলি থেকে। এই মোহরগুলি তিনি একসময় তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন।

বিকেলে মহিমের মোটর এসে থামে রাজবাড়ির দরজায়। দুপুরে খেতে না যাওয়ার জন্যে মহিম অনুযোগ করে এবং রাতের জলসার আসরে আমন্ত্রণ জানায়। লক্ষ্মৌয়ের কৃষ্ণাবাইয়ের গানের কদর করার মতো মানুষ এই এলাকায় যে একমাত্র রায়বাবু তা জানাতে ভোলে না সে। বুকে ব্যথার অজুহাতে সেই আমন্ত্রণও প্রত্যাখ্যান করেন বিশ্বম্ভর। রাতে গাঙুলীদের বাড়িতে দেখা যায় বিজলিবাতির রোশনাই। ভেসে আসে সানাইয়ের সুর। পাঁচদিন ধরে চলে আসর। বিদায় দেওয়ার সময় মহিম বাইজীকে উসকে দেয় সমঝদার আমীর রায়বাবুর সঙ্গে একবার দেখা করে যেতে।

তারাপ্রসন্ন বাইজীকে আটকানোর চেষ্টা করলেও সফল হয় না। বিশ্বম্ভরের কণ্ঠস্বর শুনে বাইজী এত্তেলা ছাড়াই উঠে যায় দোতলায়। বিশ্বম্ভর ঘোষণা করেন, ‘হবে মজলিস সন্ধ্যার সময়।’

নায়েব তহবিলের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বিশ্বম্ভর সিন্ধুক খুলে বের করে দেন একখানি জড়োয়া সিঁথি। রায়বংশের মাঙ্গলিক সিঁথি। সিন্ধুকে পড়ে থাকা শেষ অলঙ্কার।  

বহুকাল বাদে রায়বাড়িতে সমারোহ হয়। জলসাঘরের জানলা দরজা খুলে যায়। বাতিঘরের তালা খোলে, ফরাশঘরে আলো ঢোকে। গড়গড়া, বড় বড় পরাত, গোলাপপাশ, আতরদান ঘষে মেজে ঝকঝকে করা হয়। আসে হুইস্কি, সোডার বোতল। ভৃত্য অনন্তের অঙ্গে জরিদার চোপদারের উর্দি, কোমরে পেটি, মাথায় পাগড়ি, বুকে রায়বাড়ির তকমা শোভা পায়। গ্রামের বিশিষ্ট লোকেদের আমন্ত্রণ করা হয়।

আসরে গানের নেশায় সম্মোহিত অজগরের মতো তালে তালে দোলেন বিশ্বম্ভর। আনমনে পৌঁছে যান নিজের যৌবনকালে। মনে পড়ে চন্দ্রাবাইকে। চন্দ্রাবাই তাঁর জীবনের এক অধ্যায়। বিশ্বম্ভরের সম্বিৎ ফিরে আসে টাকার শব্দে। মহিম বাইজীকে বকশিশ দিয়েছে। সে নিয়ম ভঙ্গ করেছে। নিয়ম হল, প্রথম ইনাম দেবার অধিকার গৃহস্বামীর। বিশ্বম্ভর চারিদিকে চেয়ে দেখেন সম্মুখে রূপোর পরাত নেই, মোহরও নেই। উঠে পড়েন বিশ্বম্ভর। গান বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পীরা অপেক্ষা করে গৃহস্বামীর প্রত্যাবর্তনের জন্যে। কিন্তু তাঁর জায়গায় ঘরে প্রবেশ করে তারাপ্রসন্ন। হাতে রুপোর রেকাবির উপর রাখা দুটি মোহর। ইনাম। সিন্ধুকের শেষ সম্বল। তারাপ্রসন্ন জানায়, ‘বাবুর বুকে ব্যাথা উঠেছে, আর আসতে পারবেন না।’

অতিথিরা বিদায় নেওয়ার পর বিশ্বম্ভর ফিরে আসেন জলসাঘরে। হাতে তুলে নেন এস্রাজ। সেই সুরে কৃষ্ণাবাইও ফিরে আসে। সে একটার পর একটা গান গায়। বিশ্বম্ভরের শিরার, উপশিরার ছুটে বেড়ায় রায় বংশের রক্ত। ফিরে আসে যৌবনের উচ্ছ্বাস। রাত্রির শেষ প্রহরে কৃষ্ণাবাই ঘুমে ঢলে পড়লেও বিশ্বম্ভর তখনও সুর ও সুরার নেশায় উন্মত্ত। ভৃত্য অনন্তকে ডেকে তিনি আদেশ করেন পাগড়ি আর সওয়ারের পোশাক দিতে। নায়েব ঘুম ভেঙে উঠে দেখে, চোস্ত পায়জামা, মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে জরিদার নাগরা, চামর দেওয়া চাবুক হাতে রায়মশায়কে পিঠে নিয়ে তুফান তিরবেগে ছুটে গেল।

সকালের আবছা আলোয় বিশ্বম্ভর নিজেকে আবিষ্কার করলেন তাঁদের হারানো লাট কীর্তিহাটে। ঘোর কাটতে তিনি ফিরে এলেন রাজপুরীতে। তাকালেন জলসাঘরের দিকে। ঝাড়লন্ঠনে তখনও কিছু বাতি জ্বলছে। দেওয়ালের গায়ে প্রলম্বিত রায় বংশধরদের মুখে মত্ত হাসি। সহসা নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ভীতার্ত কণ্ঠে ভৃত্যকে আদেশ দিলেন, ‘বাতি নিভিয়ে দে, জলসাঘরের দরজা বন্ধ কর।’

গল্পের শেষে রায়মশায়ের হাতের চাবুক সশব্দে জলসাঘরের দরজায় আছড়ে পড়ার মধ্যে শুধু জলসাঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার ইঙ্গিত থাকে না, থাকে আভিজাত্যমণ্ডিত ঐশ্বর্যের রত্নদ্বারের একবার উন্মুক্ত হয়ে চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার বার্তাও।  

           

লালগোলার অনতিদূরে গঙ্গার ধারে পুরনো জমিদারবাড়ি দেখে এসে সত্যজিৎ তারাশঙ্করকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, মুর্শিদাবাদের নিমতিতায় তিনি ছবির লোকেশন পেয়ে গিয়েছেন। তারাশঙ্কর জিজ্ঞেস করেন, নিমতিতার রাজবাড়ি কি চৌধুরীদের বাড়ি? অতঃপর প্রকাশ পায় ‘আমার সাহিত্য জীবন’ গ্রন্থে উল্লিখিত গৌরসুন্দর চৌধুরীর প্রাসাদেই শুটিং হবে। তখন তারাশঙ্কর জানান, তিনি নিজে নিমতিতায় না গেলেও বাংলার জমিদারদের ইতিহাস সম্পর্কে পড়তে গিয়ে নিমতিতার চৌধুরীদের কথা পড়েছেন। ওই পরিবারের সঙ্গীতপ্রিয় উপেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর আদলেই তারাশঙ্কর নির্মাণ করেছিলেন জলসাঘরের নায়ককে। এই বাড়িতেই সত্যজিৎ পরে দেবী ও তিনকন্যার সমাপ্তির শুটিং করেন। নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ব্রায়ান ব্রেক ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের জন্যে ‘মনশুন ইন ইন্ডিয়া’ নামে ফটো স্টোরির শুট করেছিলেন এই বাড়িতেই। গৌরসুন্দর চৌধুরী ও তাঁর ভাই দ্বারকানাথের আমলে চৌধুরীবাড়ির প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল। ইটালিয়ান ধাঁচে নির্মিত, বড় বড় খিলান আর নক্সা কাটা জাফরি সমন্বিত এই বাড়ির ভিতর একসময় পাঁচটি উঠোন, দেড়’শর বেশি কক্ষ, নাটমঞ্চ এবং ঠাকুরদালান ছিল।   

রায়বাড়ি ও জলসাঘর দুটি গল্পকেই আধার করে চিত্রনাট্য নির্মাণ করেছিলেন সত্যজিৎ। বিশ্বম্ভর রায়ের সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগকেই তিনি ছবির মূল ভাব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসের মেজাজ, সাবেক পোশাক, সাজসজ্জা, ধ্রুপদী সঙ্গীত ও নৃত্য এবং ট্রাজিডির আমেজ মিশিয়ে একটা বানিজ্য সফল ছবি নির্মাণের অভিপ্রায়ে তিনি চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। ছবিটি প্রকৃতপক্ষেই হয়ে উঠেছিল একটি জলসাঘর। গান শোনা, নাচ দেখা, পয়সা ছোড়াছুড়ির সঙ্গে ফ্ল্যাশব্যাকে একটু একটু করে বিশ্বম্ভর রায়ের সাবেকী জমিদার সুলভ দম্ভ এবং তাঁর ক্রমাগত আত্মধ্বংস দুটি দিকই ফুটে ওঠে।

শুরুতে বিশ্বম্ভর আলোয়ান জড়িয়ে বসে আছেন প্রাসাদের ছাদে। ভোরের আলো ফুটছে। বাতাসে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর। সুরে মুগ্ধ হলেও তাঁর ব্যক্তিত্বে ফুটে উঠছে জমিদার সুলভ অহমিকা। ভৃত্যকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘সানাই কোথায় বাজছে রে?’

মহিম গাঙুলীর ছেলের উপনয়ন শুনে ফ্ল্যাশব্যাকে আসছে নিজের ছেলের উপনয়নের দৃশ্য। মহিমের বাবা তাঁর একটি মহাল কিনতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘সুদখোরের টাকায় আমার ছেলের উপনয়ন হবে না।’ তখনও রায় পরিবারের গিন্নীদের গহনাগুলি সিন্ধুকে মজুত।

ভোজ বা সান্ধ্য মজলিশের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করলেও বিশ্বম্ভর নায়েবকে দিয়ে খবর নেন প্রতি রাতে জলসার খরচ কত। নায়েব কুণ্ঠিত ভঙ্গীতে তহবিলের অবস্থা মনে করানোর চেষ্টা করলে তিনি গর্জন করে ওঠেন। মহিমের বিশ্বম্ভরের দম্ভ ভাঙার চেয়েও বিশ্বম্ভরের নিজের দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা ছবিতে বেশি তীব্র। তাঁর অহংকার,‘রক্ত! The blood in my vein.’ আর মহিম? ‘Self-made man, no pedigree.’ 

জলসাঘরে বিশিষ্ট অতিথিদের মাঝে আসর আলো করে বসেন বিশ্বম্ভর। মহিম ইনাম দিতে দেলে লাঠি দিয়ে তাকে আটকে দিয়ে তার অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে দেওয়ার দৃশ্যটি বাস্তবিকই সামন্ততন্ত্রের প্রভুত্বের চূড়ান্ত নিদর্শন। সেখানে মহিমের কাঁচুমাচু মুখখানিও দ্রষ্টব্য।

জলসা শেষ হয়। সবাই চলে যায় একে একে। বিশ্বম্ভরের মদের গ্লাসে প্রতিবিম্বিত হয় ম্রিয়মান ঝাড়বাতির আলো। বাতিগুলি একটা একটা করে নিভছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। দেওয়াল জুড়ে নিজের পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি দেখতে দেখতে আয়নায় বিশ্বম্ভর দেখছেন নিজের শেষ হাসি হাসা মুখ। নিঃস্ব হয়ে গেলেও তিনি মহিম গাঙুলীকে কিছুতেই জিততে দেন নি। সেই জয়ের আনন্দ, করুণ শরীরী ভাষায় ফুটিয়ে তুলছেন তাঁর অনুগত ভৃত্য অনন্তের কাছে। সবশেষে তুফানের পিঠে বিশ্বম্ভরের বেরিয়ে পড়া, তাঁর মৃত্যুঅভিসারে যাওয়ার সামিল। তুফানের পিঠ থেকে তাঁর পতন ও মৃত্যু যেন সামন্ততন্ত্রের প্রতীকী অবসানের আভাস।

বিশ্বম্ভরের ভূমিকায় ছবি বিশ্বাসের অভিনয় এ ছবির অন্যতম সম্পদ। তাঁর অভিজাত চেহারা, গম্ভীর চাল চলন, ঈষৎ সানুনাসিক কণ্ঠস্বর চরিত্রটিকে অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। তারাশঙ্করের কাহিনিতে মহিম গাঙুলীর যে ভূমিকা, তা ছবিতে সেভাবে না থাকলেও কাঁচুমাচু চালচলনে গঙ্গাপদ বসু চরিত্রটিকে যথার্থ ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পে বিশ্বম্ভরের পুত্রকে তেমন ভাবে না পেলেও ছবিতে পিনাকী সেনগুপ্তকে পূর্বপুরুষের ধারায় তৈরি হতে দেখা যায়। একই সঙ্গে বিশ্বম্ভরের পুত্রবাৎসল্যের দিকটিও প্রকাশিত হয়। নায়েব তারাপ্রসন্নের ভূমিকায় তুলসী রায়কে দেখা যায় গোটা ছবি জুড়ে প্রভুকে নিঃস্ব হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর বিনীত প্রয়াস। পার্শ্বচর অনন্ত একেবারে নিবেদিতপ্রাণ কর্মচারী। শেষ পর্যন্ত সে প্রভুর আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে মরিয়া।    

বাঙালি দর্শক ও শ্রোতা যে ধরণের নাচগানে আসক্ত সত্যজিতের ছবিতে তার প্রয়োগ যে ভিন্ন এবং ব্যাপক তা বলাই বাহুল্য। পুরোদস্তুর পেশাদার গায়ক ও ভারত বিখ্যাত নর্তকীদের তাঁদের নিজস্ব ভূমিকায় ছবির মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন সত্যজিৎ। বিলায়েৎ খাঁর সঙ্গীত পরিচালনা, আখতারী বাইয়ের ঠুংরী, রোশনকুমারীর নৃত্য, সালামত খাঁর খেয়াল, বিসমিল্লা খাঁ ও দক্ষিনামোহন ঠাকুরের যন্ত্রসঙ্গীতে অংশগ্রহণ এবং সর্বোপরি সত্যজিৎ রায়ের আপন সূক্ষ্ম দক্ষ শিল্প রুচির প্রয়োগ ছবিটিকে বহুগুণে সমৃদ্ধ করেছিল। তবুও ‘জলসাঘর’ বক্সঅফিসে হিট করে নি। কলকাতা ও মফস্বলের হলগুলিতে আট সপ্তাহ চলার পর বন্ধ হয়ে যায়। সত্যজিৎ রায় বলেছেন, ‘জলসাঘর হিট করে নি, তবে অল্প খরচের ছবি বলে লোকসানও হয় নি।’

অবশ্য ১৯৫৮ সালে শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে রাষ্ট্রপতির রৌপ্যপদক পায় ‘জলসাঘর’। মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের পুরস্কার লাভ করে। প্যারিসের প্রেক্ষাগৃহে ‘জলসাঘর’ মুক্তি পায় এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ছবিটি সেখানে টানা ছয় মাস চলে। ব্রিটিশ লেখক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক জন রাসেল টেলর ‘জলসাঘর’ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘হিপনোটিক’। ইতিহাসবিদ এবং চলচ্চিত্র সমালোচক ডেরেক ম্যালকম বলেছিলেন ‘সত্যজিতের মোস্ট পারফেক্ট ফিল্ম।’      

()

অভিযান

শোনা যায় ‘অভিযান’ কাহিনিটি নিয়ে ছবি করার কোনও পরিকল্পনা সত্যজিৎ রায়ের ছিল না। বন্ধু বিজন চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। পরিচালনা করছিলেন সেই বন্ধুই। দুবরাজপুরে শুটিংও শুরু হয়ে গিয়েছিল। সত্যজিৎ রায় সেখানে গিয়েছিলেন। তারপর হঠাৎই স্থির করলেন ওই ছবি তিনি নিজেই করবেন। দুবরাজপুরেই পুরো শুটিং হল। ছবি মুক্তি পেল ১৯৬২ সালে। দর্শকও গ্রহণ করলেন ছবিটি।

তারাশঙ্করের উপন্যাস ‘অভিযান’ আকার আয়তনে দীর্ঘ। উপন্যাসের মূল চরিত্র নরসিং একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। গাড়িটির মালিকও সে। পাথুরে মাটির এলাকা ইমামবাজার তার কর্মভূমি। ইমামবাজার থেকে জেলা সদর শহর পর্যন্ত নরসিংয়ের ট্যাক্সি চালানোর অনুমতি আছে। ক্লিনার নিতাই আর কন্ডাকক্টর রাম ওর সব সময়ের সঙ্গী। ওদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার চমৎকার বিবরণ দিয়ে শুরু হয় কাহিনি।

উঁচু বংশের ছেলে হলে কী হবে, ট্যাক্সি চালানোর জন্যে নরসিংকে লোকে সম্মান দেয় না। তাই তার মনে ভারি রাগ। একদিন মনোপলি বাস সার্ভিসের মালিক বুধাবাবুর মোটরকে ওভারটেক করার জন্যে শাস্তি পেল নরসিং। বুধাবাবুর গাড়িতে এসডিও ছিলেন নরসিং জানত না। ঔদ্ধত্যের কারণে নরসিংয়ের কপালে জুটল কয়েক ঘা বেত এবং ওই রাস্তায় গাড়ি চালানোর অনুমতি বাতিল হল।

ইমামবাজার ছেড়ে চলে যেতে হল নরসিংকে। সে স্থির করল নিজের দেশেই যাবে। গঙ্গার ওপাড়ে ভিন্ন জেলা মুর্শিদাবাদে তার গ্রাম। লোকে ‘গিরিবরজা’ বললেও গ্রামের আসল নাম গিরিব্রজ। গ্রামের নামের নেপথ্যের কাহিনিটিও চমকপ্রদ। নরসিং গিরিবরজার ছত্রি রাজপুত। পরশুরাম যখন পৃথিবীকে নিক্ষত্রিয় করতে উদ্যত হয়েছিলেন তখন একজন ক্ষত্রিয় নিজের পরিচয় গোপন করে চলে এসেছিল এই এলাকায়। বলেছিল, তারা জাতিতে ছত্রি। গ্রামে তাদের প্রতিপত্তি ছিল। ডোম, হাড়ি বা বাগদীরা তাদের পরিচর্যা করত, খিদমৎ খাটত। ছত্রিদের কথা এলাকায় দুটো তামার পাতে ফারসি ভাষায় লেখা আছে। রাজা মানসিং তাদের বীরত্বের জন্য গোটা গ্রামকে মৌরসিপাট্টা দিয়েছিলেন। এইসব কথা নরসিং পড়েছে একজন নবাব কানুনগোর লেখা বই থেকে। জন্ম ইস্তক নরসিং ছত্রিদের জৌলুসের কিছুই দেখে নি। এখন তারা পাইক, দারোয়ান বা চাপরাসীর কাজ করে। নরসিং শৈশবেই মাতৃহারা। বাবা জ্যাঠারা অকর্মণ্য নেশারু। লেখাপড়া শেখার আশায় নরসিং গিরিবরজা ছেড়ে ইমামবাজারে মামার কাছে চলে আসে। কিন্তু মামীর অকথ্য অত্যাচারে টিকতে পারে না। আশ্রয় নেয় এক বড় ব্যবসায়ীর বাড়িতে। ওই বাড়ির মেজবাবুই তার নতুন গুদামে নরসিংকে কাজ দেয়। প্রকৃতপক্ষে সেখানেই বড় হয় নরসিং। টাকা আয় করা, মেয়েমানুষকে ভোগ করা, মদ খেয়ে ফুর্তি করা সব দেখে সেখানে। তবে বংশমর্যাদার অহংবোধে কাপুরুষের মতো কোনও কাজ ও নিজে করে না। মামীর ভাইঝিকে জানকীকে বিয়ে করে। জানকীও মারা যায়। জানকীর ভাই রামই ওর গাড়ির কন্ডাকটর।

ইমামবাজার ছেড়ে যাবার সময় কথাগুলি স্মৃতিতে আসে নরসিংয়ের। ওর গাড়ির হর্নের শব্দে একটি গরুর গাড়ি উলটে যায়। গাড়িতে ছিল শুখন সাহু আর ফটকী। নিজের গাড়িতে ওদের শ্যামনগর পর্যন্ত পৌঁছে দেয় নরসিং। তখনই জানতে পারে সাহুর চাল আর তামাকের কারবার। ফটকীকে ওর বাবার কাছ থেকে কিনেছে সাহু। শ্যামনগরে পৌঁছে নরসিং নিজেই দুটোদিন থেকে গেল। মনে মনে ভাবল, শ্যামনগর থেকে পাঁচমতি সার্ভিস খুললে কেমন হয়? রাস্তা খারাপ, কিছু ঘোরার গাড়ি চলে। নিতাই ও রামকে নিয়ে সে সরেজমিনে দেখতে গেল। চায়ের দোকানে পরিচয় হল রামেশ্বর, রসিদ এবং জোসেফের সঙ্গে। জোসেফকে ওর ভালো লেগে গেল। জোসেফ রজনী দাস গিরিবরজার লোক। হাড়ীর ছেলে জোসেফের ঠাকুরদাদা খ্রিষ্টান হয়েছিল। জোসেফের বোন মেরি নীলিমা একটা স্কুলে পড়ায়। কালো মেয়েটি সুশিক্ষিতা বলেই নরসিং তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।

শুখন সাহু নরসিংকে উৎসাহিত করল সার্ভিস খোলার জন্যে। কারণ তাতে ওর জিনিসপত্র আদান প্রদানের সুবিধা হবে। অর্থ সাহায্যও করল সাহু। ওর যে আফিমের চোরা কারবার আর মেয়ে পাচারের ধান্দা আছে সে বিষয়ে জোসেফ সাবধান করেছে নরসিংকে। সেই থেকে ফটকীর জন্যে নরসিংয়ের দুশ্চিন্তা হয়। দুজন নারীকে নিয়ে তার মনে নিরন্তর দ্বন্দ্ব চলে। একদিকে বহুভোগ্যা অশিক্ষিত সুন্দরী ফটকী আর একদিকে কুরূপা, কালো, শিক্ষিতা নীলিমা। মনে হয় দ্বিতীয়টা মহার্ঘ্য। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, তার মতো মানুষ তো আসলে ফটকীরই উপযুক্ত।

জোসেফের সুপারিশে নরসিং সহজেই ট্যাক্সি চালানোর লাইসেন্স পায়। জোসেফ ও নীলিমা দুজনের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয় ওর। রবিবার বিকেলগুলিতে নরসিং জোসেফের বাড়িতে যায় চা খেতে। জোসেফ না থাকলেও নীলিমা সাবলীলভাবে কথা বলে। নীলিমাকে রোজ গাড়ি করে স্কুলে পৌঁছে দেয় নরসিং। পাশাপাশি ঘটনাপ্রবাহ চলতেই থাকে। কখনও মদের দোকানে ড্রাইভার, হেল্পাররা নীলিমাকে নিয়ে কুৎসিত কথা বলে। রামেশ্বরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নরসিংয়ের সঙ্গে বেইমানি করে নিতাই। নরসিংকে মারার ষড়যন্ত্র করে কেরাচি গাড়ির ড্রাইভাররা। তাতে নরসিং অবাক হয় না। ও জানে, পেটের রুটি আর মেয়েমানুষের মন নিয়েই দুনিয়ায় যত ঝামেলা! ক্রমে ক্রমে সাহুর আফিম পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে যায় নরসিং। জড়িয়ে পড়ে ফটকীর সঙ্গেও।

শ্যামনগর-পাঁচমতি ডিস্ট্রিকট বোর্ডের পাকা রাস্তা হবার সময় নরসিংকে সাহু একজন উকিলের কাছে পাঠায়। উকিল জানায়, তার বেকার ছেলে আর সাহু পার্টনারশিপে নতুন রাস্তায় মনোপলি সার্ভিস চালু করবে। নরসিংকেও ওরা পার্টনারশিপ দিতে চায়। সে মূলত সাহুর সুপারিশে। তবে ওর পুরনো গাড়ি বিক্রি করে দিতে হবে। কোম্পানির পার্টনার হওয়া নরসিংয়ের কাছে স্বপ্ন। ছোটলোক থেকে ভদ্রলোক হওয়ার চাবিকাঠি। এতদিনের গাড়িখানি বিক্রি করে দেওয়ার কথায় সে দ্বন্দ্বে পড়ে। হাজার হাজার টাকার হিসেব আর উকিলের কথার প্যাঁচে নরসিং যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই সাহু ফটকীকে নিয়ে আসে উকিলবাবুর হাতে তুলে দিতে। ‘ফটকী আমার বৌ’ বলেই, তাকে টেনে নিয়ে পালিয়ে যায় নরসিং। সেই মুহূর্তেই সে মনোপলি সার্ভিসের স্বপ্ন ত্যাগ করে। ফটকীকে নীলিমার কাছে নিয়ে যায়। নীলিমা সব কথা শুনে ফটকীর নিরাপত্তার জন্যে ওকে ব্যানার্জির বাড়িতে রাখতে যায়। ব্যানার্জি ওখানকার গির্জার পাদ্রীর ছেলে। কানা খোড়া লোকটির মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ। নীলিমার শিক্ষক হলেও নীলিমার মা বা দাদা ওকে পছন্দ করে না। নরসিংয়ের কাছে সাহায্য চায় নীলিমা। শ্যামনগর থেকে পালিয়ে গিয়ে সে ব্যানার্জিকে বিয়ে করবে। দ্বিধাবিভক্ত নরসিং সাহায্য করে নিলিমাকে। নরসিংয়ের বিরুদ্ধে ফটকীকে অপহরণ করার জন্যে মামলা হয়। ফটকী সাবালিকা হওয়ায় মুক্তি পায় নরসিং।

উপন্যাসের অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে প্রতেকটি চরিত্রের জীবনকথা ইতিহাসের মতো বিধৃত হয়েছে। নরসিং, তার পিতামহী, নরসিংয়ের মামা মামী, নরসিংয়ের বৌ, তার ভাই, মেজবাবু, নিতাই, জোসেফ, নীলিমা, তাদের মা, জোসেফের ঠাকুরদার কথা তাঁর সরস লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। বহু বিচিত্র স্বভাবের মনুষ্যকুলকে পাওয়া গিয়েছে উপন্যাস জুড়ে। একই সঙ্গে ভিন্ন দুটি সময়কালের ছবিও চমৎকার ভাবে ধরা পড়েছে। 

উপন্যাসের শেষে আবার একটা নতুন পথে অভিযান শুরু হয় নরসিংয়ের। শ্যামনগর ছেড়ে চলে যাচ্ছে সে। চলেছে কয়লা খাদানের দিকে। সঙ্গে আছে ফটকী, রাম আর জোসেফ। নীলিমা ও তার স্বামী চাকরি করে অন্ডালে। তারাই দিয়েছে এই নতুন ঠিকানা। সেখানে দুই বন্ধু ড্রাইভারী করবে। ফটকী আর স্বৈরিণী নয়, সে নরসিংয়ের বৌ। তাকে নিয়ে সংসার করবে নরসিং।

সত্যজিতের ছবিতে নরসিং অস্থির, ক্রুদ্ধ, যুক্তিবাদী ট্যাক্সি ড্রাইভার। দুই চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে তার অসীম আবেগ, হৃদয়ের যন্ত্রণা আর কাঙালপ্রতিম আকাঙ্খা। মনোপলি ট্রান্সপোর্টের মালিক বুধাবাবু তার বৌকে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাই তার মনে এক রাশি বিদ্বেষ। টাকার লোভে তার বৌ ভেগেছে তাই তার ঘৃণা সমগ্র মেয়েজাতির প্রতি। তার টাক্সিতে সে কোনও মেয়ে মানুষকে উঠতে দেয় না। এছাড়া তার যন্ত্রণার অন্যতম কারণ তার বংশমর্যাদা ও আত্মসম্মান জ্ঞান। লোকে যতবার মনে করিয়ে দেয়, ট্যাক্সি চালায় তাই সে ছোটলোক ততবার সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।

শুরুতে বেশকিছু রঙিন মফস্বল যাত্রীদের নিয়ে পরিহাস যোগ্য আবহ তৈরি করেছেন সত্যজিৎ। ছবিতে ফটকীর নাম বদল করে গুলাবী রাখা হয়েছে। তাকে একজন বেশ্যা হিসেবেই দেখানো হয়েছে আগাগোড়া। তার অতীতের কোনও আভাস না থাকলেও একটা উন্নত জীবনের প্রতি তার আকাঙ্খা দেখা যায়। নিতাই চরিত্রটিকে পুরোপুরি বাদ দিয়েছেন সত্যজিৎ। ছবিতে নরসিংয়ের একজনই সঙ্গী। রাম। ওদের সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যের।

চায়ের দোকানে, মদের দোকানে নানা পেশা এবং নানা মানসিকতার মানুষগুলির চরিত্র এক একটি দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে বর্ণনা করেছেন সত্যজিৎ। শুখন সাহুর  ক্রুরতা এবং অসততা তার গৃহসজ্জা অথবা দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলির মধ্যে দিয়েই ফুটে উঠেছে। সরকারী অফিসারদের প্রভাব অথবা ক্ষমতা ফুটে উঠেছে তাদের বিশাল সুসজ্জিত বাংলো অথবা হাতের লাঠি নাচানোর ভঙ্গীতে। মদ অথবা জুয়ার আড্ডায় সংখ্যালঘু গ্রাম্য খৃষ্টান পরিবারকে নিয়ে কুৎসা করা অথবা শিক্ষিত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা তরুণীর প্রতি অশ্লীল ইঙ্গিত সমাজের হিংস্র কুটিল চেহারাটি তুলে ধরেছে।

নরসিংয়ের শ্যামনগরে থেকে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার নিজের থেকেও শুখনরামের বেশি আগ্রহ দেখা যায়। তার জন্যে সে খরচ করে হাত খুলে। তার দেওয়া প্রস্তাবে শুরুতে নরসিংয়ের দ্বিধা এবং পরে সম্মত হওয়া, প্রতীকীভাবে ফুটে ওঠে বন্দুক আকৃতির বাহারি লাইটারটি নরসিংয়ের সরিয়ে রাখা ও তুলে নেওয়ার দৃশ্যেদুটির মধ্যে।

জোসেফ নরসিংকে শ্যামনগর চেনায়। সেই চেনানোর দৃশ্যে মামা-ভাগ্নে পাহাড়ের পাথরগুলিকে নানান ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেন সত্যজিৎ। নরসিংয়ের রাজপুত রক্ত টগবগ করে উঠছে পাথুরে জায়গাটি দেখে। পাপী ও পাপীর পিঠে পাপের বোঝার মতো দাঁড়িয়ে থাকা পাথরগুলিকে শুভ এবং অশুভ শক্তির ইঙ্গিত হিসেবে ছবিতে শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ।

নীলিমার কাছে ইংরাজী শিখে নরসিং ‘ছোটলোক’ তকমা থেকে মুক্ত হতে চেয়েছে। শিক্ষিতা মেয়েটির সাহচর্য তাকে তৃপ্তি দিয়েছে। নীলিমার কথা মতো মদ খাওয়া কমিয়েছে সে। নীলিমার নামে ড্রাইভাররা কুৎসা করলে সে মারপিট করেছে। নীলিমা যখন তার প্রেমিকের সঙ্গে চলে যাবার জন্যে নরসিংয়ের সাহায্য নিয়েছে, তখন ক্রুদ্ধ হয়েছে। সেই ক্রোধ, আপসোস, ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে আকন্ঠ মদ্য পান করে গুলাবীকে কামনা করার মধ্যে দিয়ে।

গুলাবী আগেই তাকে ভেলবেসেছিল। এরপর সে স্বপ্ন দেখল। সে শুখনরামের খপ্পর থেকে বেরিয়ে ঘর বাঁধতে চায়। উকিল আর সাহুর সঙ্গে পার্টনারশিপে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির ব্যবসার লোভ উড়িয়ে দিতে পারে না নরসিং। অসৎ পথ হলেও এই পথই যেন তার ছোটলোক থেকে ভদ্রলোক হয়ে উঠার সিঁড়ি।

জেনেশুনেই নরসিং আফিম পাচার করতে যায়। পথে জোসেফের সঙ্গে দেখা হয় তার। নরসিং প্রাণপনে আড়াল করে রাখে ঘিয়ের টিন। গাড়িটা যখন কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না, জোসেফ সাহায্য করতে গিয়ে সব দেখে ফেলে। তখন জোসেফের দৌড়ে পালানোর দৃশ্যের মধ্যে পাপের সঙ্গকে প্রত্যাখান করার ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠে। পেছনে ছোটে নরসিং। তখনই পাহাড়ের উপর বসে থাকা একটা শকুন দেখা যায় দৃশ্যে। নরসিং সিদ্ধান্ত নেয় এ কাজ সে করবে না। সঙ্গে সঙ্গে তার গাড়ি স্টার্ট নেয়। ঘিয়ের টিন ফেরত দিতে গিয়ে নরসিং দেখে সাহু গুলাবীকে নিয়ে উকিলের কাছে বেচে দিতে গিয়েছে। রামকে তুলে নিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে যায় সে। রাজপুতের বেশে একটা ঝলকে নরসিংয়ের আত্মমর্যাদা ফিরে পাওয়ার আভাস দেখা যায়। গুলাবীকে সাহুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সে চলে যায় শ্যামনগর ছেড়ে। আবার দেখা হয় জোসেফের সঙ্গে। ওর পায়ের কাছে সাহুর কাছ থেকে নেওয়া শৌখিন লাইটারটা ফেলে দিয়ে নরসিং যেন বুঝিয়ে দেয়, এবার সে সৎভাবে জীবনযাপনে প্রস্তুত।

অভিযান ছবিটি বক্স অফিসে সফল হয়। নরসিংয়ের ভূমিকায় সৌমিত্রের অভিনয় নিঃসন্দেহে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ আঞ্চলিক রূপ, চরিত্রের ব্যঞ্জনা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। রামের ভূমিকায় রবি ঘোষ অনেকগুলি দৃশ্যের তীব্রতা ও যন্ত্রণা সফলভাবে উন্মোচিত করেছেন। নির্বুদ্ধিতা থেকে গভীর বিষণ্ণতার আবেগ চমৎকার ফুটিয়েছেন তাঁর শরীরী ভাষায়। গনেশ মুখার্জি ও রুমা গুহঠাকুরতা গ্রাম্য খ্রিষ্টানদের অবমাননার আর্তি ফুটিয়ে তুলেছেন সফলভাবে। অনেক সমালোচক বলেছেন, গুলাবীর চরিত্রে ওয়াহিদা রেহমানকে নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ছবিটির প্রচার বাড়ানো। অভিনয় ভালো করলেও অক্ষর পরিচয়হীন, আতঙ্কিত,  গ্রাম্য-বালিকার চরিত্রটি সেভাবে ফুটে ওঠে নি।

তারাশঙ্কর তাঁর উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে সমাজকে যেভাবে ব্যবহার করেছিলেন তাতে নরসিং পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু সত্যজিতের নরসিংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে এত বড় করে দেখানো হয়েছে যে তাকে সত্যিই শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধি বলে ভাবতে কষ্ট হয়। লোকটা সারাজীবন ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়েই কাটাবে ভাবলে দর্শকদেরই যেন আপসোস হয়। 

পরিশেষে বলা যায়, জলসাঘর বা অভিযান দুটি ক্ষেত্রেই কাহিনির দিকবদল ঘটেছে সত্যজিতের হাতে। সাহিত্য থেকে এই দিকবদল তাঁর চিত্রনাট্যে বারংবার দেখা গিয়েছে। মূল কাহিনির লেখকরা এতে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। তবুও সত্যজিৎ নির্দয়। এর থেকে তাঁর নিজের লেখা ফেলুদার কাহিনিগুলিও রেহাই পায় নি। বহু গবেষক মনে করেছেন, মূল কাহিনিকে এভাবে ঢেলে সাজানোর কারণ সত্যজিতের নিজস্ব ইতিহাস ও সমাজচেতনা। তবে সত্যজিৎ রায় নিজে বলেছেন, ‘মূলত সিনেমার নিজস্ব চাহিদা পূর্ণ করতেই এই পরিবর্তন।’

তথ্যসুত্রঃ

১। আনন্দবাজার পত্রিকা ৫ই জুলাই, ২০১৪

২। এই সময়, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

৩। আনন্দবাজার পত্রিকা ৩০ এপ্রিল, ২০১৫

৪। আনন্দবাজার পত্রিকা ১৪মে, ২০১৬

৫। আমার সাহিত্য জীবন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

৬। সত্যজিৎ জীবন আর শিল্প,  সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত।

৭। সত্যজিৎ-ভাবনা, উজ্জ্বল চক্রবর্তী।

৮। The Week, June 22, 2o18