সত্যজিতের শঙ্কু কাহিনী : সায়েন্স ফিকশান না থ্রিলার ?

১৯৬১ সালে সন্দেশ পত্রিকা যখন আবার প্রকাশিত হবে নতুন করে, সেই সময়ে সম্পাদক সত্যজিৎ তৈরি করলেন শঙ্কু চরিত্রটি। এর প্রথম গল্প ব্যোমযাত্রীর ডায়রি নতুন পর্বের সন্দেশের প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হল। তখনো অবধি সায়েন্স ফিকশান নামক গোত্রটি বাংলা সাহিত্যে প্রায় অনুপস্থিত। যদিও বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর ১৮৯৭ সালে লেখা উন্মত্ত সমুদ্রতে তেল ঢেলে তাকে শান্ত করার একটি কাহিনীকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সায়েন্স ফিকশান বলে এখন মনে করা হয়, তবে এই গল্পটির কোনও ধারাবাহিকতা থাকে নি। ফলে সত্যজিৎ থেকেই বাংলা এমনকি ভারতীয় সাহিত্যের সায়েন্স ফিকশানের শুরু, এরকম আমরা ধরে নিতে পারি।

প্রোফেসর শঙ্কু সিরিজে মোট ৩৮টি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও ২টি গল্প অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়ে গিয়েছে, যা সত্যজিৎ শেষ করতে পারেন নি। গল্পগুলি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেশ ও আনন্দমেলা পত্রিকায়। পত্রিকায় প্রকাশের পরে সেগুলি গুচ্ছাকারে বিভিন্ন শঙ্কু গ্রন্থে স্থান পায়।  ১৯৬৫ সালে শঙ্কু সিরিজের প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রোফেসর শঙ্কু প্রকাশিত হয়। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে শঙ্কু সিরিজের মোট আটটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলি হল প্রোফেসর শঙ্কু (১৯৬৫), প্রোফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা (১৯৭০), সাবাস প্রোফেসর শঙ্কু (১৯৭৪), মহাসংকটে শঙ্কু (১৯৭৭), স্বয়ং প্রোফেসর শঙ্কু (১৯৮০), শঙ্কু একাই একশো (১৯৮৩), পুনশ্চ প্রোফেসর শঙ্কু (১৯৯৩), সেলাম প্রোফেসর শঙ্কু (১৯৯৫)। পরবর্তীকালে শঙ্কুসমগ্র গ্রন্থে এই সিরিজের সকল গল্প সংকলিত হয়।

সূচনাকালের কোনও একটা নির্দিষ্ট গল্পে প্রোফেসর শঙ্কুর সামগ্রিক পরিচয়টি সত্যজিৎ আমাদের জানিয়ে দেন নি। বস্তুতপক্ষে লিখনের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে সেটি সম্ভবও ছিল না। কোনও সর্বজ্ঞ ও সর্বগ অথর আমাদের শঙ্কু কাহিনীগুলি শোনান নি। এগুলি আমরা জেনেছি স্বয়ং শঙ্কুর ডায়েরি থেকে। ডায়েরির বিভিন্ন এন্ট্রিতে শঙ্কু মাঝে মাঝে নিজের কথা বলেছেন। শঙ্কু মূলত পদার্থবিজ্ঞানী। তবে বিজ্ঞানের সকল শাখায় তার অবাধ গতি। রসায়ন, ভূতত্ত্ব, প্রাণীবিজ্ঞান ছাড়াও ভাষা ও লিপিবিজ্ঞানে তাঁর দখল প্রবল। শঙ্কু ৬৯টি ভাষা জানেন, হায়ারোগ্লিফিক তো বটেই, সিন্ধু সভ্যতার লিপি পর্যন্ত পড়তে তিনি সক্ষম। তিনি মূলত আবিষ্কারক এবং এক্ষেত্রে টমাস আলভা এডিশনের পরেই তাঁর নাম বিশ্বে সমাদৃত। প্রোফেসর শঙ্কুর আবিষ্কার নামে এক প্রবন্ধে দেবাশিস মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে প্রোফেসর শঙ্কুর মোট ৭২টি আবিষ্কারের কথা জানা যায়। এই সব আবিষ্কার ও তাদের নামকরণের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের ভাষাপ্রীতি ও কৌতুকবোধের পরিচয় মেলে। যেমন, শঙ্কু আবিষ্কৃত রোবট বিধুশেখর সাধু ও চলিত বাংলায় কথা বলতে পারে; শঙ্কু তৃষ্ণানাশক বড়ির নাম ‘তৃষ্ণাশক বড়ি’। শঙ্কুর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল বটিকা ইন্ডিকা, এয়ারকন্ডিশানিং পিল, লিঙ্গুয়াগ্রাফ, লুমিনিম্যাক্স, সমুনলিন, রিমেম্ব্রেন, মিরাকিউরল, রোবু ও বিধুশেখর নামক দুটি রোবট, অ্যানাইহিলিন পিস্তল, শ্যাঙ্কোপ্লেন, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন-শঙ্কু ফরমুলা ইত্যাদি। তবে এইসব আবিষ্কারকে তিনি মুনাফা অর্জনের কাজে কখনো ব্যবহার করেন না।

শত প্রলোভনেও শঙ্কু সামান্যতম বিচলিত হন না। প্রবল প্রতাপশালীর রক্তচক্ষুকে সহজে উপেক্ষা করার সাহস ও চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁর আছে। বিজ্ঞানের জগতের মানুষ হয়েও বিশ্বের নানা প্রান্তের ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি ও বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে তিনি খুব ভালোভাবে অভিহিত। মানুষ হিসেবে শঙ্কু ঋষিপ্রতিম। সমাজ ও জগতের কোনও কিছুর থেকে কোনও আকাঙ্ক্ষা তাঁর নেই, কেবল রয়েছে প্রবল জ্ঞানতৃষ্ণা আর অনুসন্ধিৎসা। তাঁর বন্ধু অবিনাশচন্দ্র বয়সের কথা মনে করিয়ে তাঁকে মাঝে মাঝে রিটায়ার করার পরামর্শ দেন, কিন্তু শঙ্কু মনে করেন জানার আগ্রহ কখনো থামে না। তাই তাঁকে গবেষণা চালিয়েই যেতে হবে। শহরের ভিড় থেকে দূরে গিরিডিতে একাকী নির্জন বাড়িতে তিনি থাকেন। চাকর প্রহ্লাদ ও বেড়াল নিউটন ছাড়া সেখানে তার আর কোনও সঙ্গী নেই। আত্মীয় পরিজন তেমন কেউ নেই শঙ্কুর, অবিনাশ বাবু ছাড়া অন্য প্রতিবেশীও তেমন কেউ কখনো আসেন না। ল্যাবরেটরিতে কাজের ফাঁকে কেবল শঙ্কু মাঝে মাঝে বাড়ির কাছের উশ্রী নদীর ধার থেকে ঘুরে আসেন। তবে যেহেতু বিজ্ঞানী হিসেবে শঙ্কুর খ্যাতি বিশ্বজোড়া, তাই তাঁকে নানান দেশে নানা সম্মেলনে যেতে হয়। ইংল্যাণ্ড, জার্মানি, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন এরকম ইউরোপের নানা দেশে তিনি গেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও পাড়ি দিয়েছেন জাপান, মিশর, চিলি ইত্যাদি জায়গায়। সাহারা মরুভূমিতে গেছেন অভিযান সূত্রে। আবার মঙ্গলগ্রহেও পাড়ি দিয়েছেন একই কারণে।

সত্যজিৎ যখন শঙ্কু কাহিনী লেখা শুরু করছেন তখন বাংলা সাহিত্যে এই ধারার রচনার তেমন কোনও নজির নেই ঠিকই, কিন্তু বিশ্বসাহিত্যে অনেকদিন আগেই সায়েন্স ফিকশানের বিকাশ প্রতিষ্ঠা ঘটে গেছে। মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে (১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত) অনেকেই সায়েন্স ফিকশানের সূচনা বলে মনে করে থাকেন। মেরি শেলি অবশ্য ভূতের গল্পই লিখতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ে মেরি শেলি, তাঁর স্বামী কবি পি বি শেলি ও তাঁর বন্ধু কবি বায়রন একসঙ্গে অবকাশ কাটাচ্ছিলেন। তিনজনেই একটি করে ভূতের গল্প লিখবেন বলে ঠিক হয়। মেরি শেলি লেখেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। পরে অনেকে এটিকেই একালের সায়েন্স ফিকশানের সূচনা বলে মনে করতে চান। অনেকে অবশ্য আরো পেছোতে চেয়েছেন। ১৬৩৪ সালে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান কেপলার একটি গল্প লিখেছিলেন সোমনিয়াম নামে। সেই গল্পে পৃথিবী থেকে চাঁদে যাওয়া ও সেখান থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণন দেখার কথা আছে। সময়ের বিচারে যাকে সায়েন্স ফিকশান ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। তবে পরে এই ফিকশান বাস্তবতায় পরিগণিত হয়েছে। বস্তুত এই ব্যাপারটা অনেক বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশানের ক্ষেত্রেই পরবর্তীকালে ঘটেছে। জুলে ভার্ন এর টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি রচনার সময়ে সাবমেরিনের ধারনাটি ছিল চমকপ্রদ এক কল্পনা, পরে সেটি বাস্তবতায় নেমে আসে। চন্দ্রাভিযানের বাস্তব আয়োজনের একশো বছর আগেই এর কাহিনী জুলে ভার্ন লিখেছিলেন ও সেখানে নানারকম বৈজ্ঞানিক হিসাব নিকাশ ছিল। মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ছাড়াও উনিশ শতকের প্রথম অর্ধে রচিত এডগার অ্যালান পোর বেশ কিছু গল্পে সায়েন্স ফিকশানের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে যে দু জন সায়েন্স ফিকশান জাতীয় রচনার জন্য বিশেষ খ্যাত হন তাঁরা হলেন জুলে ভার্ন ও এইচ জি ওয়েলস। জুলে ভার্ন এর বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে - ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন (১৮৬৩), জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ (১৮৬৪), ফর্ম দ্য আর্থ টু মুন (১৮৬৫), রাউন্ড দ্য মুন (১৮৭০), টোয়েনটি থাউজ্যান্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি (১৮৭০), অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ (১৮৭২) ইত্যাদি। জুলে ভার্ন এর অল্প পরেই কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য দুনিয়াকে আলোড়িত করেন এইচ জি ওয়েলস। তাঁর টাইম মেশিন (১৮৯৫) এবং দ্য ইনভিজিবল ম্যান (১৮৯৭) উনিশ শতকের একেবারে শেষদিকে প্রকাশিত হয়। জুলে ভার্ন এবং এইচ জি ওয়েলস এর রচনার অনুবাদ বাংলা ও মারাঠি সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষাতে বিশ শতকের প্রথম দিকেই প্রকাশিত হয়েছিল এবং সায়েন্স ফিকশান সাহিত্যের এই ক্লাসিক রচনাগুলির অনুবাদের মধ্যে দিয়েই বাঙালি তথা ভারতীয় ভাষার পাঠক কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন।

পশ্চিমে অবশ্য সায়েন্স ফিকশান রচনায় তখন জোয়ার এসেছে। তা পাঠক মহলে প্রবল জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। ১৯২৬ সালে আমেরিকায় হুগো জেনসবার্গ শুধু সায়েন্স ফিকশানের জন্যই একটি স্বতন্ত্র পত্রিকা – অ্যামেজিং স্টোরিজ - প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সায়েন্স ফিকশান কাকে বলা যাবে এবং সায়েন্স ফিকশানের নামে লেখা অজস্র কাহিনীকে কেন এই গোত্রের মধ্যে আনা ঠিক হবে না এসব বিচারের দিকেও তিনি এগোন। হুগো গেনসবার্গ লেখেন –

By 'scientifiction' I mean the Jules Verne, H. G. Wells and Edgar Allan Poe type of story—a charming romance intermingled with scientific fact and prophetic vision... Not only do these amazing tales make tremendously interesting reading—they are always instructive. They supply knowledge... in a very palatable form... New adventures pictured for us in the scientifiction of today are not at all impossible of realization tomorrow... Many great science stories destined to be of historical interest are still to be written... Posterity will point to them as having blazed a new trail, not only in literature and fiction, but progress as well.

সত্যজিৎ যখন এর প্রায় সাড়ে তিন দশক পরে বাংলায় কল্পবিজ্ঞান কাহিনী লেখা শুরু করছেন, তৈরি করছেন প্রফেসর শঙ্কু চরিত্র, ততদিনে পশ্চিমে এই ধারায় আরো অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ হয়ে গেছে। ১৯৩৭ সালে শুরু হয় জন ক্যাম্বেলের সম্পাদনায় ‘অ্যাসটাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশান’ নামের এক নতুন পত্রিকা এবং অনেকেই মনে করেন এই পত্রিকার সূত্রেই সায়েন্স ফিকশান রচনার স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। ১৯৪২ সালে আইজাক অ্যাসিমভ তাঁর ফাউন্ডেশান সিরিজ লেখা শুরু করেন এবং বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব সব কিছু মিলেমিশে সায়েন্স ফিকশান এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছায়।

অ্যাসিমভের ফাউন্ডেশন সিরিজে ইন্টার গ্যালাক্সি বিচরণের কাহিনী আমরা পেয়েছি। সত্যজিতের শঙ্কু কাহিনীর প্রথমটিতেও আমরা এই ধরনের এক অভিযানের কথা আমরা পড়ি। সত্যজিৎ নিশ্চয় অ্যাসিমভ পড়েছিলেন, সেখান থেকে প্রেরণাও হয়ত পেয়েছিলেন লেখার, তবে এই সঙ্গে এটাও মনে রাখার যে বছর সেপ্টেম্বরে এই শঙ্কু কাহিনী প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে, ১৯৬১ র সেই বছরেই এপ্রিল মাসে ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশে ঘুরে আসেন। এই প্রথম সফল মহাকাশ অভিযান বিশ্বজুড়েই প্রবল আলোড়ন ফেলেছিল এবং সমকালীন সেই ঘটনার অভিঘাত নিশ্চিতভাবে সত্যজিৎকে প্রভাবিত করে থাকবে।

সত্যজিৎ প্রথম শঙ্কু কাহিনীটি যখন লেখেন তখন ধারাবাহিক কোনও শঙ্কু সিরিজ লেখার পরিকল্পনা তাঁর ছিল কিনা জানা নেই। তবে এই গল্পের আদল দেখে মনে হয় না সেই সময় কোনও সিরিজ লেখার পরিকল্পনা তাঁর ছিল। কারণ গল্পের শেষে শঙ্কু তাঁর আবিষ্কৃত আকাশযানটি নিয়ে মহাশূন্যের অজানায় হারিয়ে যাচ্ছে এরকম ইঙ্গিৎ ই ছিল আর সেটাও ভিন গ্রহের প্রাণীদের থেকে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে কোনওক্রমে পালানোর পর। এই শঙ্কু কাহিনীটি উল্কা পতনে সৃষ্ট এক গহ্বরের মধ্যে পাওয়া ডায়েরিতে লেখা ছিল, যা ইঙ্গিৎ করে শঙ্কু ও মহাকাশযানের শেষ আশ্রয় ছিল এই উল্কাটিই, যা শেষে পৃথিবীর বুকে জ্বলন্ত পিণ্ড হিসেবে আছড়ে পড়ল ও বিলুপ্ত হয়ে গেল।

পরে যখন সত্যজিৎ সন্দেশের প্রয়োজনে ও অন্যত্র কিশোর সাহিত্য নিয়মিত লিখতে শুরু করলেন তাঁর পরিচালক জীবনের পাশাপাশি, সেই সময় ফেলুদার পাশাপাশি তিনি আবার ফিরিয়ে আনলেন শঙ্কুকেও। কিন্তু শঙ্কু সশরীরে আর ফেরেন নি। পত্রিকা সম্পাদক শঙ্কুর গিরিডির বাড়িতে গিয়ে আগে লিখে রেখে যাওয়া এরকম আরো অনেকগুলো ডায়েরি খুঁজে পান এবং সেই সমস্ত ডায়েরির লেখাগুলিই বিভিন্ন শঙ্কু কাহিনী হিসেবে এরপর মুদ্রিত হয়েছে। সেই অর্থে প্রথম প্রকাশিত শঙ্কু কাহিনীটি শঙ্কুর শেষ অভিযান ও শেষ ডায়েরি লিখন।

শঙ্কুকে আবার সত্যজিৎ ফিরিয়ে আনলেন দু বছর পর। সন্দেশের পাতাতেই। দ্বিতীয় শঙ্কু কাহিনীটির নাম ছিল “প্রফেসর শঙ্কু ও হাড়”। প্রথম গল্পটি সোভিয়েতের প্রথম মহাকাশ অভিযানের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছিল এবং কল্পবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যই সেখানে ছিল। দ্বিতীয় এই গল্পটিতে কিন্তু বিজ্ঞানের জায়গা নিল মন্ত্রতন্ত্র এবং কল্পবিজ্ঞানের জায়গা থেকে সেটা অনেকটাই ফ্যান্টাসির গোত্রে গিয়ে পড়ল। এই গল্পে শঙ্কু নেহাৎই এক পার্শ্বচরিত্র, মূল চরিত্র জনৈক সাধুবাবা। তিনি মন্ত্রবলে হাড় থেকে প্রাণীর পুনর্জন্ম ঘটাতে পারেন আবার তাকে মেরেও ফেলতে পারেন মন্ত্রবলে। অলৌকিকের কাছে বিজ্ঞান এখানে হার মানে, রেকর্ডার যন্ত্রে শঙ্কুর রেকর্ড করা মন্ত্রটি পর্যন্ত অলৌকিক কায়দায় সেই সাধু মুছে দিতে পারেন। অলৌকিকের কাছে বিজ্ঞানের এই পরাভব আর যাই হোক, একে কল্পবিজ্ঞান হিসেবে আখ্যা দিতে পারে না।

প্রফেসর শঙ্কু ও ইজিপ্সিয় আতঙ্ক নামে প্রথম দিককার আরেকটি গল্পেও এই অতি লৌকিকের প্রাধান্য। মিশর দেশ থেকে কীভাবে সেই অনামা লোকটি মমির পেছন পেছন চলে এল শঙ্কুর বাড়িতে, তার কোনও বাস্তব ব্যাখ্যা নেই। অতিলৌকিক হিসেবেই তাকে ধরে নেন পাঠক। কয়েক হাজার বছর আগে বেড়ালের আক্রমণে জনৈক মিশরীয়র মৃত্যুর এক পুনরাভিনয় আবার ঘটে শঙ্কুর গিরিডির বাড়িতে, যখন বেড়াল নিউটনের আক্রমণে বিশ শতকের এই মিশরীয়টি মারা যান। এই অতিলৌকিকের আবরণে চাপা পড়ে যায় মমি নিয়ে শঙ্কুর গবেষণার জায়গাটি, যে গবেষণার নাকি উদ্দেশ্য ছিল মমি তৈরির রাসায়নিক উপাদানগুলি বিশ্লেষণ করা। বস্তুতপক্ষে একের পর এক শঙ্কু কাহিনী বিশ্লেষণ করে দেখানো যায় বৈজ্ঞানিক যুক্তিশৃঙ্খলা প্রায়শই অতিলৌকিকের কাছে হার মেনেছে।

তবে সব শঙ্কু কাহিনীই এমন নয়। প্রফেসর শঙ্কু ও ম্যাকাও গল্পে পাখি ও মানুষের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার যে কথা আছে, তা সায়েন্স ফিকশান এর অন্যতম ক্লাসিক এইচ জি ওয়েলস এর ইনভিজিবল ম্যান এর সময় থেকেই এক জনপ্রিয় কল্পনা। এখানে অলৌকিক নয়, অতি লৌকিককে অন্তত রসায়ানগার থেকে তৈরি করার বিষয়টি এসেছে। একই কথা বলা যায় প্রফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল গল্পটি প্রসঙ্গেও। দেহের আয়তনকে দশভাগ ছোট করা বা দশগুণ বড় করার যে বিষয়টির ওপর এই গল্পটি আধারিত, সেটিকেও গবেষণাগার থেকে তুলে আনার চেষ্টা রয়েছে এবং এই অতিলৌকিক উপস্থাপণ বিজ্ঞানের সম্ভাব্যতার যুক্তিসীমাকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করে যায় না।

শঙ্কু কাহিনীতে প্রায় সব সময়েই রহস্য রোমাঞ্চের নাটকীয় উপস্থিতি আমরা দেখি। বৈজ্ঞানিক চমৎকারিত্বের চেয়ে বেশি গুরুত্ব নিয়ে আখ্যানগুলিতে হাজির হয় একজন ভিলেনের দুর্বৃত্তপণা এবং গল্পের শেষে শঙ্কু কখনো নিজে, কখনো বা অন্য কেউ সেই দুর্বৃত্তের শাস্তিবিধান করে। শঙ্কু কাহিনীর দুর্বৃত্তরা অনেকসময়েই নিজেরাই বিজ্ঞানী, অনেকে নিজেরা বিজ্ঞানী না হলেও বিজ্ঞানকে কার্যসিদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করে নিতে পটু। দুর্বৃত্ত বিজ্ঞানী হিসেবে ‘প্রফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল’ গল্পের গ্রেগর লিন্ডকুইস্ট এর উদাহরণ আমরা ভাবতে পারি, যার শখ নিজের আবিষ্কারের সূত্র ধরে বিখ্যাত লোকেদের পুতুল বানিয়ে রাখা। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ম্যাকাও’ গল্পের প্রোফেসর গজানন তরফদারও এই তালিকায় আসবেন। আবার কর্ভাস গল্পের যাদুকর অর্গাস নেহাৎই একজন তস্কর। শঙ্কুর শেখানো বিদ্যায় পারদর্শী প্রতিভাবান কাক কর্ভাসকে চুরি করে সে আরো বড় যাদুকর হয়ে উঠতে চায়।

শঙ্কুর বিজ্ঞান কাহিনীতে বৈজ্ঞানিক কল্পনা ও গবেষণার বদলে এত বেশি গোয়েন্দা কাহিনী সুলভ রহস্য রোমাঞ্চ কেন সেই প্রশ্ন পাঠকের মাথায় আসতে পারে। সত্যজিতের হাতে তো ফেলুদাও ছিলেন এই সমস্ত রহস্য রোমাঞ্চভিত্তিক গল্পগুলির জন্য। সত্যজিৎ কেন বিজ্ঞানভিত্তির দিকে শঙ্কু কাহিনীগুলিতে আরো বেশি এগোলেন না ? কোনও সাক্ষাৎকারে এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি কখনো সত্যজিৎ হয়েছেন কিনা আমাদের জানা নেই, হয়ে থাকলে সত্যজিতের উত্তর কী হত, তাই নিয়ে আমাদের কৌতূহল আছে। তবে এর উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে আমাদের নিজেদের মনে হয় এর বেশ কয়েকটি কারণ আছে। সত্যজিৎ বহুপাঠী হলেও বিশুদ্ধ অর্থে বিজ্ঞানের ছাত্র বা পাঠক ছিলেন না। তাই এই ক্ষেত্রে তিনি হয়ত বেশি গভীরে ঢুকতে চান নি পূর্বজ এইচ জি ওয়েলস, জুলে ভার্ন, অ্যাসিমভ বা সমকালীন আর্থার সি ক্লার্কদের মতো। দ্বিতীয় একটি বিষয় হল শঙ্কু কাহিনীর প্রাথমিক পাঠক কিশোর কিশোরীরা, এই গল্পগুলি মূলত প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেশ বা আনন্দমেলার মতো কিশোর পত্রিকাগুলিতে। কিশোর মনের উপযোগী করেই গল্পগুলিকে তাই সত্যজিৎ সাজাতে চেয়েছিলেন। আমাদের দেশে এই সেদিন পর্যন্ত জনপ্রিয় বিজ্ঞানগ্রন্থ লেখার তেমন চল না থাকার কারণে কিশোর উপযোগী সায়েন্স ফিকশান এর বাইরে সর্বসাধরণের জন্য গভীর সায়েন্স ফিকশান সেভাবে লেখাই হয় নি। বিশ শতকের শেষ ও একুশ শতকের গোড়ার দিকে মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অদ্রীশ বর্ধনদের গভীরতর সায়েন্স ফিকশান আমরা পেয়েছি। সত্যজিতের শঙ্কু কাহিনীতে নায়ক প্রতিনায়ক জাতীয় রহস্য রোমাঞ্চের বাড়বাড়ন্তর আর একটি কারণ যে সময়ে এই গল্পগুলি মূলত লেখা হচ্ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সেই কয়েক দশক জুড়ে বিজ্ঞান, বিশেষ করে তার ব্যবহার, সমাজের জন্য কতটা আশীর্বাদ আর কতটা অভিশাপ - এই সংশয় আমজনতা থেকে সমাজভাবুক সবার মধ্যেই ঘোরাফেরা করেছে। পরমাণু বোমা থেকে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার অস্ত্র প্রতিযোগিতা, ভোগবাদী সমাজে বিজ্ঞানকে সামাজিক কল্যাণের বদলে ব্যক্তিগত মুনাফার কারণে ব্যবহারের প্রবণতা এই সংশয়ের জন্ম দিয়েছিল। এই সংশয় থেকেই সম্ভবত সত্যজিতের শঙ্কু কাহিনীতে খল চরিত্রের কারবারীরা ভিড় করে আসে।

শঙ্কু কাহিনীতে নারী চরিত্রের উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি আমাদের নজর এড়ায় না। শঙ্কুর বাবা বা ভাইয়ের কথা গল্পে কখনো কখনো এলেও মায়ের কথা কোথাও নেই। নেই তাঁর কোনও প্রতিবেশিনীর নামগন্ধ। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশুনো বা তরুণ বয়সে অধ্যাপণার সূত্রে কখনো কোনও তরুণীর সঙ্গে তাঁর আলাপ পরিচয়ের সংবাদ পর্যন্ত আমরা পাই না, হৃদয়ের কারবার তো দূর অস্ত। কোনও বিজ্ঞান সম্মেলনে বিজ্ঞানী, আয়োজক, সাংবাদিক – প্রায় কোথাও কোনও নারী চরিত্র নেই। শঙ্কু কাহিনীর তো শুধু পাঠক ছিল না, কিশোরী পাঠিকাও ছিল। সন্দেশ আনন্দমেলার সেই কিশোরীরা স্বর্ণপর্ণীর মতো দু একটি বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত নারী বিশ্ব বিবর্জিত এই শঙ্কু আখ্যানকে কীভাবে গ্রহণ করেছিল ?

শঙ্কু কাহিনীতে আর নেই রাজনীতি। দেশের বা বিদেশের কোনও রাজনৈতিক ঘটনার প্রসঙ্গ শঙ্কু কাহিনীতে আসে না। শঙ্কু কাহিনীগুলি ষাট সত্তর আশির দশক জুড়ে যখন তৈরি হচ্ছে তখন বিশ্বজুড়ে মার্কিন ও সোভিয়েতের মধ্যে চলছে কোল্ড ওয়ার। কোল্ড ওয়ারের প্রসঙ্গ দূরে থাক, সোভিয়েত দুনিয়াতেই কখনো শঙ্কু পা রাখে নি, ন্যাটোভূক্ত দেশগুলিতেই তার বেশি যাতায়াত। এটা সত্যজিতের সচেতন বাছাই ছিল এমন অনুমান করা যেতেই পারে, কারণ সোভিয়েত বিজ্ঞানের তখন রমরমা ও সেখানে নিয়মিত নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক সম্মেলন হত। কেবলমাত্র একটি আখ্যানেই রাজনীতি সরাসরি এসেছে। তবে সেটি সমকালীন নয়। তিন দশকের পুরনো। স্বর্ণপর্ণী গল্পে শঙ্কুকে অপহরণ করে নাৎসী বাহিনীর লোকজন। শঙ্কুকে দিয়ে তারা হিটলারের ডানহাত গোয়রিং এর শুশ্রুষা করাতে চায়। শঙ্কু এই নরঘাতক রাজনীতিবিদকে সুস্থ করে তুলতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি গেস্টাপো বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে সেখান থেকে সরে পড়েন। এই আখ্যানে হিটলারের জমানার ভয়ানক দিকগুলি একদম সরাসরি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। এই উদ্ধৃত অংশটির কথাই ধরা যাক, যেটি আবার শঙ্কু কাহিনীতে প্রায় বিরল এক নারী, সন্ডার্সের স্ত্রী ডরোথির মুখের সংলাপ –

‘ভারতবর্ষে বসে শুধু খবরের কাগজ পড়ে ইউরোপে কী ঘটছে না ঘটছে সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যায় না। গত কয়েক বছরে জার্মানিতে হিটলারের অভ্যুত্থান ও নাৎসি পার্টি সংগঠনের কথা অবিশ্যি জানতাম, কিন্তু সেটা যে কী ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে এবং হিটলারের আত্মম্ভরিতা ও তার শাসনতন্ত্রের যথেচ্ছাচারিতা যে কোন স্তরে পৌঁছেছে, সেটা দেশে বসে ধারণা করতে পারিনি। ডরথি বলল, ইংরাজিতে পাওয়ার-ম্যাড বলে একটা কথা আছে জান তো? হিটলার সেই অর্থে উন্মাদ। সমস্ত ইউরোপকে গ্ৰাস করে সে একটা বিশাল জার্মান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখছে। তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা-গোয়রিং, গোয়বেলস, হিমলার, রিবেনট্ৰপ…। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ।’

হীরক রাজার দেশের মতো অসাধারণ অ্যালিগরি থাকলেও  গোটা সত্যজিৎ সাহিত্যে, এমনকি সিনেমাতেও এরকম প্রত্যক্ষ স্পষ্ট সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য আর নেই। অন্তত এই একবার কিশোরপাঠ্য বলে রাজনীতিকে শঙ্কু কাহিনী থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়োজন সত্যজিৎ অনুভব করেন নি। বরং নিজের টানা গণ্ডীকে নিজেই ভেঙেছেন।