না-শরীরী কাহন - নিকোলাই গোগোলের ‘ডেড সোলস' এর নাট্যরূপ - ৪
- 07 July, 2025
- লেখক: বিপ্লব বিশ্বাস
প্রথম অঙ্ক : তৃতীয় দৃশ্য
–------------------------------------
।। মানিলভের বাড়ি।।
মানিলভ : এই যে মি. চিচিকভ, মনে হয় না আমাদের ডিনার এতটাই লোভনীয় যে শহরের জাজিম বিছানো পথ মাড়িয়ে আপনি এখানে এসে পৌঁছলেন?
চিচিকভ :ঠিক তা নয়। দুদণ্ড ভালো কথা আর ভালো ব্যবহার খাবার পদের চাইতে অনেক বেশি লোভনীয় আমার কাছে।
মানিলভ : আপনি কি আমার পড়ার ঘরের দিকে আসবেন?
চিচিকভ : ছিঃ,ছিঃ। ওভাবে বলবেন না, দয়া করে। আমি আপনাকে অনুসরণ করছি। চলুন।
মানিলভ : আরে না, না, প্যাভেল ইভানোভিচ চিচিকভ। হাজার হলেও আপনি আমার অতিথি।
চিচিকভ : এতটা বিব্রত হবেন না প্লিজ। চলুন, এগোনো যাক।
মানিলভ : আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। আপনার মতো একজন শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান অতিথিকে আমি পিছন পিছন আসতে দিতে পারি না।
চিচিকভ : এর সঙ্গে আবার শিক্ষাদীক্ষার সম্পর্ক কী? চলুন না, আপনিই আগে চলুন।
মানিলভ : না স্যার, তা হয় না। আপনিই আগে চলুন।
চিচিকভ : কেন বলুন তো? এমন পীড়াপীড়ি করছেন? আমি বলছি তো…
মানিলভ : ঠিকাছে স্যার, এর কারণ হল…
( ওরা একে অপরের দিকে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে তাকায়। দুজনেই আটকে যায় আর নিজেদের প্রকাশ করে। শেষত ওরা পড়ার ঘরের দিকে এগোয়।)
মানিলভ : আসলে এটা আমার ছোট্ট এক চিলতে ঘর তো…
চিচিকভ : বাঃ, কী সুন্দর ঘর! মহামান্য, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য তাই একটা সময়ে জীবনকাব্য কাটখোট্টা ব্যাবসার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে।
মানিলভ : প্রথমে স্যার, এই বিশেষ হাতল চেয়ারে একটু আরাম করে বসুন।
চিচিকভ : আপনি যদি অনুমতি দেন তবে এখানটাতেই ( অন্যত্র) বসি।
মানিলভ : আপনাকে অনুমতি না দেবার জন্য অনুমতি দিতে পারি। আপনাকে বলি, এই হাতল চেয়ারটি আপনাদের মতো বিশেষ অতিথিদের জন্যই বানানো। তাঁরা পছন্দ করুন বা নাই করুন, এই চেয়ারে তাঁদের বসতেই হবে।
( তারা উভয়েই বসে। চিচিকভ ঝুঁকে ব্যাবসার কাজ শুরু করতে গেলে মানিলভ আবার তাকে বাধা দেয়)
মানিলভ : আগে একটু ধূমপান করে নিন। দেখবেন, দারুণ মজার একটি নরম ব্লেন্ড।
চিচিকভ : যদি অনুমতি দেন, আমি ধূমপান করি না। ডাক্তারি শাস্ত্রে বলে, ধূমপানে গলার ঝিল্লি শুকিয়ে যায়।
মানিলভ : বাঃ, আমাদের আলোচনা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত হচ্ছে, বেশ দুর্লভ। অবশ্য আপনি যদি আমাকে দার্শনিকের মতো বলতে অনুমতি দেন তবে বলি, নাকে নস্য নেবার চাইতে ধূমপান বেশি স্বাস্থ্যকর। তা ছাড়া আপনার আগমনে আমরা ধন্য হয়েছি। এমন আনন্দ যেন মে মাসের একটি দিন, প্রাণ -মনের ছুটি।
চিচিকভ : কী যে বলেন? আমি কি তেমন কেষ্টবিষ্টু কেউ?
মানিলভ : বলছেন কী? আপনার সব আছে এমনকি বেশি বেশিই আছে।
চিচিকভ : মহামান্য মানিলভ, আপনি মহানুভব। আমি একজন সাধারণ মানুষের চাইতে বেশি কিছু নই।
মানিলভ : ওঃ, প্যাভেল ইভানোভিচ, আজ যদি আমরা দুজন কোনওভাবে এক সঙ্গে বাস করতে পারতাম, একই ছাদের নিচে, কিংবা আরও ভালো হত এই যদি এল্ম গাছের বড়ো বড়ো পাতার ছায়ায়… অথবা গভীর কোনও ভাবনায় মগ্ন হতে পারতাম, ঢুকে যেতে পারতাম একদম তলদেশে কিংবা বিজ্ঞানের কোনও জটিল গবেষণায় হারিয়ে যেতে পারতাম, অচেনা, অজানা পথে… এবং তার শেকড় ধরে নাড়া দিতে পারতাম এবং সে সব গবেষণার ফসল একে একে ভেসে উঠত… তবে কী ভালোই না হত…!
চিচিকভ : ঠিক বলেছেন ভাই, আমার চোখের সামনেও ভেসে উঠছে সব… ওপরে… ওপরে ( চারদিকে তাকিয়ে)। কিন্তু আমরা যখন এখনও মাটি ছুঁয়ে আছি তখন ব্যাবসার তুচ্ছ বিষয় - আশয়ই আমাদের বিব্রত করে চলে। তাই না? আপনার কি মনে পড়ে স্যার, অতি সম্প্রতি আপনার অধীনের মুনিষ- কামিনদের ওপর শুমারি ও ট্যাক্স রিপোর্ট কীভাবে করেছিলেন?
মানিলভ : হ্যাঁ, কিছুদিন আগের ব্যাপার বটে। আরও সঠিকভাবে বললে বলতে হয় - আমি মনেই করতে পারছি না ঠিক।
চিচিকভ : যাই হোক, তখন থেকে আজ অবধি আপনার চাষিদের কি অনেকেই দেহ রেখেছে?
মানিলভ : হ্যাঁ, মারা তো গেছেই… তবে আমি কি জানতে পারি, এ সব আপনি জানতে চাইছেন কেন?
চিচিকভ : জানতে চাইছি কেন? ( গভীর শ্বাস নিয়ে) বলব, অবশ্যই বলব। আমি চাষি কিনতে বেরিয়েছি।
মানিলভ : ও, আপনি আমার কয়েকটি চাষিকে কিনতে চান? হুঁ পাবেন।
চিচিকভ : আরে থামুন, থামুন। আপনি যা ভাবছেন, তা নয়, ঠিক তা নয়। চাষি কিনতে চাই, এটা ঠিক। তবে জীবিত নয়, মৃত।
মানিলভ : কী!?
চিচিকভ : ঠিক তাই। আমি না- শরীরী চাষিদেরই কিনতে চাই যদি তা আপনার হিসাবে থাকে।
( মানিলভের হাত থেকে সিগ্রেটের পাইপ পড়ে যায় ও সে থ মেরে যায়)
চিচিকভ : ভাবলাম, আপনি হয়তো আপনার মজুত চাষিদের তালিকা সব গুলিয়ে ফেলেছেন, তাহলে সেগুলো অর্থাৎ ওই মৃতদের আমাকে দিতে পারেন। মানে, এক অর্থে ওরা জীবিত নয় ঠিকই কিন্তু আইনের নথি অনুযায়ী বেশি বেশি করে জীবিত। রীতিমতো কর দেওয়া সম্পত্তি বুঝতে পারছেন? ( একটু থেমে) কথাগুলো শুনতে বেয়াড়া লাগছে,না?
মানিলভ : আমি?... বেয়াড়া…না, মানে, এর আগে পর্যন্ত যা কিছু বলেছেন কোনওটাই বেয়াড়া ঠেকেনি। কিন্তু, মাফ করবেন, আমার তো আপনার মতো বিদ্যেবুদ্ধি নেই। আমার এই ভোঁতা মাথায় মনে হয়েছে, আপনার প্রতিটি কথার লুকনো কিছু মানে আছে। আর তাই… হুঁ…বুঝেছি… আপনি প্রতীকী ভাষায় কথা বলছেন। আলংকারিক বিন্যাসের গভীরে আপনার কথার আসল অর্থ লুকিয়ে আছে। এটাই আপনার কথা বলার সুন্দর শৈলী। এবার আমি ঠিকই বুঝতে পারছি।
চিচিকভ : না, না। ভিতরের ব্যাপার-স্যাপার কিছু নয়। আমি যা বলেছি তাই বোঝাতে চেয়েছি। মৃত আত্মা। ( একটু থেমে) সেখানে মশাই, বাধার যদি কিছু না থাকে, ঈশ্বর কৃপা করুন, আমরা সরাসরি সে বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হতে পারি।
মানিলভ : কী বললেন? কী চুক্তিবদ্ধ হওয়া? মরা মানুষের ওপর?!
চিচিকভ : আরে না, না, হা ঈশ্বর! মরা মানুষ হবে কেন? আইনত জীবিত সত্তা। পাক্কা আইনমাফিক। গত সরকারি শুমারির তালিকা অনুসারেই আমাদের বিক্রি কবলা হবে। এটি একটি আইনগত প্রশ্ন। আমি তেমনই মানুষ যে কখনও বে-আইনি কোনও কাজ করেনি। আমাদের পবিত্র রাশিয়ার রাজকোশও এতে লাভবান হবে। হ্যাঁ। এই যে বিক্রি কবলার প্রক্রিয়ায় কে আইনগত ফি-টি নেবে বলে আপনি মনে করেন?
মানিলভ : তাহলে আপনার ধ্যান-ধারণা হচ্ছে -
চিচিকভ : এতে ভালোই হবে।
মানিলভ : সত্যি যদি ভালোই হয়, তাহলে আলাদা ব্যাপার।
চিচিকভ : তাহলে আর থাকলটা কী? হ্যাঁ, দামের ছোট্ট বিষয়টি।
মানিলভ : হ্যাঁ, দাম। কত? অনুমতি দিলে বলি, আমার দিক থেকে কোনও লাভ ছাড়াই আপনাকে এদের দেব। আর দলিলের ফি বিষয়ে খরচ - খরচাও আমিই দেব।
চিচিকভ : ( খুশির আতিশয্যে মানিলভের হাত দুটি টেনে চুম্বন করে) আমার প্রিয়, প্রিয় বন্ধু…ওঃ…
মানিলভ : প্যাভেল ইভানোভিচ, দেখুন, সারাটা সময় ধরে আমাদের দুটি মনের এই যে নিষ্ঠাপূর্ণ চৌম্বক আকর্ষণ সেটাই কোনও না কোনওভাবে প্রমাণ করার পথ খুঁজে চলেছি। আর যে সব চাষিরা, ধরুন মারা গেছে, তারা তো এক অর্থে জঞ্জাল ছাড়া কিছুই নয়।
চিচিকভ : না, জঞ্জাল আদৌ নয়। কোনওভাবেই নয়। এটা যদি আপনি জানতেন যে এইসব, আপনার মতে, জঞ্জাল বেচে একজন দুর্ভাগা ছোটো জাতের মানুষের ওপর কী আশীর্বাদই না বর্ষণ করছেন… ( হঠাৎই গলার স্বর পালটে) জানেন, এখনই এইসব মরা আত্মাদের বেচে দেওয়াটা কতটাই ভালো হবে? শুধু প্রতিটি চাষির নাম ধরে ধরে একটা লিস্টি বানিয়ে ফেলুন। আর আপনি যদি নিজেই বিক্রিকবলা করতে একটু শহরে আসেন তাহলে তো তাড়াতাড়িই ঝামেলা চুকে যায়, বুঝলেন না?
মানিলভ : নিশ্চিন্ত থাকুন। এক- দুদিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
চিচিকভ : (টুপিটা খুলে) ঠিকাছে, তাহলে এটা আমাদের মধ্যে সংক্ষিপ্ততম কথাবার্তা। তাই তো?
মানিলভ : তার মানে? এখনই উঠছেন নাকি? লিজানকা, প্যাভেল ইভানোভিচ চলে যাচ্ছেন।
মানিলভের স্ত্রী : ( বনবন জাতীয় দুটি মিষ্টি প্লেটে করে ঢোকে) আরে, আমি আরও কিছু মিষ্টি আপনাদের মুখে দেব বলে তৈরি হচ্ছি( ছেনালি ঢঙে), কিন্তু পরে মনে হল আমরা বোধ হয় মি.চিচিকভের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠছি ( বলেই মানিলভের মুখে একটা মিষ্টি গুঁজে দেয়)।
চিচিকভ : বিরক্তিকর!( বুকে হাত ঠেকিয়ে) ম্যাডাম, এখানে, এই এখানে, আপনাদের সাহচর্যে যে আনন্দ জমা হল তা চিরকাল মনে থাকবে। আঃ, যদি ব্যাপারটি হয়েই যায় তবে জানবেন, এক সঙ্গে থাকাটা কতই না ভালো হবে… এক ছাদের নিচে না হলেও পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকা…! তবে এখন আসি ম্যাডাম ( মহিলার হাতে চুমু খেয়ে), বিদায়, আমার নবতম, মূল্যবান বন্ধু, বিদায় ( মানিলভকে আলিঙ্গন করে) শহরে দেখা হচ্ছে তাহলে?
( বাকহারা দুজনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়। চিচিকভ বিদায় নেয়, জয়ের তৃপ্তিতে শিস দিয়ে গাইতে গাইতে বেরিয়ে যায়)
মানিলভ : ( একা) কোনও নদীতটে সবুজ সমারোহে দুজনে এক সঙ্গে বাস করতে পারলে কতই না সুন্দর হবে… অথবা উঁচু চিলেকোঠাযুক্ত একটি বাড়ি যাতে মস্কো অবধি পুরো রাস্তাটা স্পষ্ট দেখা যায়… যেখানে বসে দুজনে চা-পান করতে পারি একদম খোলা আকাশের নিচে। বাড়ি থেকে নদী পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে একটা রাস্তা তারপর নদীর ওপর দিয়ে একটা ব্রিজ আর সেই ব্রিজ বরাবর ছোটো ছোটো দোকান… সেখানে আমাদের ব্যবসায়ী থাকবে, থাকবে দোকানের মালিক যারা দোকানে বসে ভূমিদাসদের জীবন নির্বাহের প্রয়োজনে খুচখাচ জিনিস বেচবে। তারপর সেই রাস্তা ধরে চিচিকভকে নিয়ে হাই সোসাইটিতে বেড়াতে যাওয়া… আঃ…চি…চি…ক…ভ! কী সুরেলা নাম! আর জার, আমাদের সম্রাট, আমাদের এই জাঁকালো বন্ধুতা দেখবে আর খুশি মনে যোগ্য উপাধি দান করবে। চিচিকভ আর আমি… জেনারেল হিসেবে… জেনারেল মানিলভ, জেনারেল চিচিকভ… ( বলতে বলতে ওর মুখমণ্ডলের রং পালটা যায়)...কিন্তু ওরা তো মৃত! নয় কি!?
প্রথম অঙ্ক : চতুর্থ দৃশ্য
………………………………….
সবাকেভিচের বাড়ি। ছবির গ্যালারি। খাঁচায় একটা থ্রাশ পাখি। ঘরে প্রচুর আসবাবপত্র। ডিনার থেকে উঠে আসছে সবাকেভিচ আর চিচিকভ। উভয়েই দোল খাচ্ছে আর উদগার তুলছে।
টীকা : যেহেতু সবাকেভিচ হামবড়ামার্কা আবেগপ্রবণ অভব্য একটা লোক তাই চিচিকভকেও হয় একই রকম আবহাওয়া তৈরি করতে হয়, নয়তো তার নিরেটভাবের কিনার ধরে সাবধানে চলার পন্থা মাথা খাটিয়ে বের করে করে এগোতে হয় যা কিনা মানিলভের সঙ্গে চলার ঠিক বিপরীত একটি প্রক্রিয়া।
সবাকেভিচ : এরকম একটি ডিনার আপনি শহর ঢুঁড়ে আর কোথাও পাবেন না।
চিচিকভ : তা ঠিক, তবে গভর্নরের ডিনারটিও খারাপ ছিল না।
সবাকেভিচ : কী পাগলের মতো বকেন? আমি আপনাকে ভেড়ার পিঠের সুস্বাদু মাংসের ভিতর বাক গম ( বাজরা) ভরে খাওয়ালাম। ওই যে খেলেন তো চেটেপুটে। কিন্তু গভর্নরের ওই শয়তান ফরাসি রাঁধুনিটা, ও একটা বেড়ালের চামড়া ছাড়িয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে খাওয়াবে কিংবা ব্যাঙের মাংস চিনি ছিটিয়ে ভটকাবে আর তাই আপনাকে গিলতে বাধ্য করাবে। আমি ও সব ছুঁয়েও দেখি না এমনকি ঝিনুকের মাংসও না। আমি জানি, ঝিনুক খেতে কেমন লাগে ; ফরাসি আর জার্মান ডাক্তারেরা ওই সব রোগীপথ্যের বিধান দেয়… প্রকৃত রুশ পাকস্থলী সম্পর্কে ওদের কি কোনও ধারণা আছে? আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ওরা কী বোঝে হে? আমার ঘরে যদি শুয়োরের মাংস হয় তবে গোটা শুয়োরটাই টেবিলে হাজির করি। ভেড়ার মাংস হলেও তাই। আর এই যে আমার ছবির গ্যালারি দেখছেন ( বড়ো বড়ো মূর্তি দেখিয়ে), কে নেই এখানে… ম্যাভরোকরডাটো, গ্রিসদেশের কম্যান্ডার, কলোকট্রনি, গ্রিসের জেনারেল, স্বাধীনতার যুদ্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল এঁরা… বাগরাশান, এ আমাদেরই একজন… দেখুন তো কত সতেজ, মাংসল লাগছে… ওটা আমার পোষা থ্রাশ।… আমাকে কী জিজ্ঞেস করছিলেন যেন?
চিচিকভ : আপনাকে? ও তেমন কিছু নয়। এই প্লায়ুশকিনের বাড়ির রাস্তাটা জানতে চাইছিলাম আর কি। মানে, আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সদর দরজার বাঁদিকে না ডানদিকে? এটাই।
সবাকেভিচ : প্লায়ুশকিন!? এ ব্যাপারে কোনও পথই আপনাকে দেখাব না। প্লায়ুশকিন! ওই কুত্তাটা! হাড়কিপটে কোথাকার! ওর ভূমিদাসদের খেতে না দিয়ে দিয়ে এক্কেবারে মাছির মতো মেরে ফেলেছে, শয়তানটা!
চিচিকভ : তাই!একেবারে মাছির মতো?
সবাকেভিচ : ( দাবড়ি মেরে) আমি অপেক্ষা করছি।
চিচিকভ : কীসের জন্য?
সবাকেভিচ : উদ্দেশ্য জানতে।
চিচিকভ : উদ্দেশ্য?
সবাকেভিচ : আপনার আগমনের উদ্দেশ্য।
চিচিকভ : উদ্দেশ্য তেমন কিছু নয়। ( বিবেচকের মতো দৃঢ় পদক্ষেপে) বিদেশ থেকে আসা পর্যটকেরা রুশ সাম্রাজ্যের এই বিশালতা, নানান আকর্ষণীয়, অকল্পনীয় সব ব্যাপার - স্যাপার দেখে একেবারে মোহিত হয়ে যায়।
সবাকেভিচ : একটা বলুন।
চিচিকভ : সহজেই স্যার, এই যেমন আমাদের রুশ আইনকানুন, এই যে গ্রামীণ কমিউন ব্যবস্থায় এর যে ভিত…
সবাকেভিচ : আপনি আইনকানুনে আগ্রহী নন।
চিচিকভ : আমি নই?
সবাকেভিচ : আপনি একজন ব্যবসায়ী। তাই আপনার সঙ্গে কথা বলছি।
চিচিকভ : এখানে একটি আইনই আমাকে বড্ড বেশি টানে। তা হল, সমস্ত রুশ যারা এই ইহলোক ভ্রমণ শেষে অন্য লোকে ফিরে গেছে তারা সবাই সমানভাবে বেঁচে আছে, জীবিত, অন্তত আইনি ভাষায় - যতক্ষণ না আগামী সরকারি শুমারি হচ্ছে। এতে করে বড়ো বড়ো জোতদারদের বোঝা অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে - এই ধরুন, আপনার মতো যারা আর কি, যারা সততার সঙ্গে ওইসব মৃত ভূমিদাস বা আত্মাদের ওপরেও ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছেন… শুধু ট্যাক্স তালিকায় নাম থেকে গেছে বলেই ন্যায্য বিচারে এটা আপনারা করে যাচ্ছেন যদিও তারা কেউই আর জীবিত নেই। রাশিয়ার এই আইনটায় আমার খুব মজা লাগে স্যার। খু…উব।
( এই বলে চিচিকভ ওকে সতর্কতার সঙ্গে নিরীক্ষণ করতে থাকে। একইভাবে সতর্কতার সঙ্গে ঘুরে তাকায় সবাকেভিচ)
সবাকেভিচ : আপনি না- শরীরী মানুষ চাইছেন?
চিচিকভ : হ্যাঁ, না, মানে অস্তিত্বহীন আর কি?
সবাকেভিচ : তার মানে মৃত?।
চিচিকভ : হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন।
সবাকেভিচ : ( আগ্রহ দেখিয়ে) ফাইন, আমি বেচব।
চিচিকভ : বেচবেন? বাঃ।
সবাকেভিচ : আপনার পক্ষে তেমন বেশি কিছু হবে না ; মাথাপিছু একশো রুবল দেবেন।
চিচিকভ : একশো!
সবাকেভিচ : কেন? আপনার পক্ষে তা নিশ্চয়ই দুঃসাধ্য হবে না?
চিচিকভ : আমরা, মনে হয়, একে অপরকে ঠিক বুঝতে পারিনি। আত্মাপ্রতি আশি কোপেক হলেই সঠিক হয়।
সবাকেভিচ : আরে আরে, এটা একটা দাম হল? এ কথা উচ্চারণ করতে আপনার লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল। মাত্র আশি কোপেক! এক রুবলও নয়! ঠাট্টা রাখুন। আসুন, একটা ন্যায্য দাম ঠিক করি।
চিচিকভ : এর বেশি আমি পারব না স্যার। বিশ্বাস করুন, একেবারে ধর্মত বলছি, এর বেশি আমার পারার ক্ষমতা নেই। আচ্ছা, শেষ কথা। জনপ্রতি আধ রুবল ধরে দিচ্ছি।
সবাকেভিচ : এমন কিপটেমি করছেন কেন? আমি আপনাকে ছেঁড়া চটি বেচছি না। অন্য যে কোনও ঠগ আপনাকে ঠকাবে ; ভালো আত্মার বদলে পচা-ধচা আত্মা বেচবে ; কিন্তু আমার এ সব পাক্কা এক নম্বর, ওক গাছের শাঁস সব। যদিও পুরো সুদক্ষ নয়, তবুও এরা কর্মী হিসেবে শক্তপোক্ত তো বটেই। এই যে ধরুন মিচিয়েভ, গাড়ি বানানোর দক্ষ কারিগর ; নানান আসবাবপত্র দিয়ে ঘর সাজানো থেকে শুরু করে কাঠের যাবতীয় কাজ, সবেতেই ওস্তাদ।
চিচিকভ : দয়া করবেন, আমার পক্ষে…
সবাকেভিচ : আবার দেখুন, মিলুশকিন ; রাজমিস্ত্রি। ইটের গাঁথনির কাজে ওস্তাদ। যে কোনও বাড়িতে আগুন জ্বালাবার চুল্লি বানিয়ে দিতে পারত।
চিচিকভ : যদি অনুমতি দেন…
( তার কথা শেষ হয় না। সবাকেভিচের বাক্যস্রোতের তোড়ে তা ভেসে যায়)
সবাকেভিচ : কিংবা এই ধরুন, মাকসিম তেলিয়াতনিকভ ; চামড়া ফুটো করার ছোট্ট সুচটা যে কোনও বস্তুর মধ্যে একবার ঢুকিয়ে দিলেই হল, একজোড়া বুটজুতো তৈরি হয়ে যাবে চট করে। এমন জুতো মশাই যা আপনি চোখেই দেখেননি। আর দেখবেনও না। আর মদ? ছুঁয়েও দেখে না। এ আমি হলফ করে বলতে পারি। এমনই সব দুর্দান্ত আত্মা এরা। বুঝলেন?
চিচিকভ : ওদের এ সব গুণাগুণ আমার কাছে ব্যাখ্যা করে কী লাভ? ওরা তো সব গত। সব্বাই।
সবাকেভিচ : ( মনে করতে চেষ্টা করে) হ্যাঁ, ঠিকই, তারা সব মৃত। আবার এদিকে যদি দেখেন, যারা বেঁচে আছে তারাই বা কী গুণের সব? মাছি, সব মশাই মাছি। মানুষ নয়।
চিচিকভ: তবুও তো তারা আছে। অথচ এরা তো এখন শুধুই স্বপ্ন, মায়া!
সবাকেভিচ : না, না, শুধুই স্বপ্ন হবে কেন? মিচিয়েভ কেমন মানুষ ছিল, তাহলে শুনুন( বলে ঘাড় ঝাঁকিয়ে শুরু করল)। এমনকি এই ঘরটিতেও তাকে ঠিক মানাত না। ওর মতো আর একটি খুঁজে বের করুন, তাহলেই বুঝবেন, স্বপ্ন কেমন হয়।
চিচিকভ : প্রিয় সবাকেভিচ, বিষয়টা কেমন যেন খাপ খাচ্ছে না, বুঝতে পারছেন? আমি বলতে চাইছি, এই পুরো আলোচনাটাই এখানে সরাসরি… যাকগে বাদ দিন। এ লোকগুলো কেমন ভালো? কে চাইছে এদের?
সবাকেভিচ : আপনিই তো এদের কিনতে চাইছেন, তাই এদের প্রয়োজন আছে। নয় কি?
চিচিকভ : দুই রুবল, মাথাপিছু। আর নয়।
সবাকেভিচ : তাহলে আমারও শেষ কথা শুনুন। পঞ্চাশ রুবল, জনপ্রতি। ব্যস।
চিচিকভ : আপনি এটা ভালোই জানেন, অন্যত্র গিয়ে বিনে পয়সায় এদের জোগাড় করতে পারি।
সবাকেভিচ : ঠিকাছে, সেখানেই যান। তবে খুব সাবধানে। আমাদের মধ্যেকার কথাবার্তা… এ তো আর আমাদের মধ্যেই…
চিচিকভ : স্যার, এটা জানবেন, আমি পরিষ্কার আইনের পথেই হাঁটা মানুষ। আপনি যদি বেচতে না-ই চান তাহলে বিদায়… আসি, মি. সবাকেভিচ।
সবাকেভিচ : ( দাঁড়িয়ে) এক মিনিট। এক মিনিট ( চিচিকভের হাত চেপে ধরে আর এই ফাঁকে জোরে ওর পা মাড়িয়ে দেয়) ওঃ, লাগল বুঝি?
( এরপর ওরা বসে, পায়ে লাগা নিয়ে চিচিকভ উশখুশ করতে থাকে)
চিচিকভ : না, না। ঠিক আছে। শুধুশুধুই আমার সময় নষ্ট করছি। যত তাড়াতাড়ি হয় এখান থেকে চলে যাওয়াই উচিত। যত তাড়াতাড়ি হয়।
সবাকেভিচ : প্লিজ শুনুন, একটি ভালো কথা শুনুন ( কাছাকাছি বসে) আমার প্রথম দামটা মনে করুন তো? সেখানে আপনি কী বলছেন? তার সিকিভাগ?
চিচিকভ : পঁচিশ রুবল? না, না, তার সিকিভাগও নয়। আর একটা কোপেকও বাড়াব না।
সবাকেভিচ : তাহলে তো দেখছি আপনার কাছে একটি মানুষের আত্মার দাম একটা সেদ্ধ ওলকপির চাইতে বেশি নয়। যাহোক, কমপক্ষে তিন রুবল দিতেই হবে। জনপ্রতি।
চিচিকভ : না, না, তা হয় না। বড়োজোর আড়াই।
সবাকেভিচ : না, হল না। আমার আর কিছু করার নেই। আমার ক্ষতিই হল, যেমন হয় আরকি - কুকুরের মতো। বন্ধুদের সুখী না করে আমি পারি না। আর কী? এবারে তাহলে বিক্রিকবলাটি করে ফেলা যাক। স ঠিকঠাক আছে তো?
চিচিকভ : অবশ্যই।
সবাকেভিচ : ঠিকাছে। আমি শহরে যাব দলিলে সইসাবুদ করতে। এখন আমায় আগাম কিছু দিন।
চিচিকভ : আগাম? কেন? শহরে যখন যেতেই হবে তখনই না হয় পুরোটা বুঝে নেবেন?
সবাকেভিচ : এভাবেই তো এ সব হয়ে থাকে মশাই। আপনি তো জানেন। তাইতো অগ্রিম বা আগাম কথাটি আছে।
চিচিকভ : কিন্তু তা কীভাবে আপনাকে দেব, আমার জানা নেই। সত্যিই সঙ্গে করে আমি কিছু আনিনি…না, না, দাঁড়ান…এই যে দশ রুবল আছে।
সবাকেভিচ : পঞ্চাশ রুবল চাই। নইলে চুক্তি বাতিল।
চিচিকভ : আমার কাছে তো এর বেশি নেই?
সবাকেভিচ : আছে।
চিচিকভ : ও হ্যাঁ, এই নিন পনেরো… পঁচিশ হল। রসিদ দিন।
সবাকেভিচ : রসিদ! কেন?
চিচিকভ : না, মানে কিছুই তো বলা যায় না। কিছু মনে করবেন না। অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।
সবাকেভিচ : ঠিকাছে, টাকাটা দিন আগে।
চিচিকভ : এইতো, হাতেই ধরা আছে। এই যে দেখুন। রসিদ দেখামাত্রই পেয়ে যাবেন।
সবাকেভিচ : ভালো মজা! আগে তো টাকাটা পেতে হবে! তারপর তো রসিদ?
( উভয়েই তৈরি। সবাকেভিচ রসিদ লেখে, চিচিকভ টাকা তুলে দেয়)
সবাকেভিচ : এই বিলটা পুরনো বুঝলেন? আপনি কোনও মহিলার আত্মা চাইতে পারবেন না।
চিচিকভ : অনেক ধন্যবাদ।
সবাকেভিচ : ঠিকাছে, তাহলে…
চিচিকভ : আর একটা অনুরোধ। আমাদের এই চুক্তির বিষয়টি আমাদের মধ্যেই থাকবে। বাইরে যাবে না।
সবাকেভিচ : তা আর বলতে। আমরা কথা- কাজ ঠিক রাখার মানুষ। বিদায়। এখানে আসার জন্য ধন্যবাদ।
চিচিকভ : ও হ্যাঁ, প্লায়ুশকিনের বাড়ির রাস্তাটা বললেন না তো? ডানে না বাঁয়ে?
সবাকেভিচ : প্লায়ুশকিন! প্লায়ুশকিন! ওই কুত্তাটা?
চিচিকভ : কিছু মনে করবেন না। আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব মজা পেলাম। গুড বাই। ( চিচিকভ চলে যায়)
সবাকেভিচ : ( জানলা দিয়ে লক্ষ করে) কী পাঁজি লোক রে বাবা…!